রংয়ের শিশু,
রঙিন শিশু

January 18, 2018

শিশুরা ছবির মাধ্যমে প্রথম গণিতের শিক্ষা নেয় আবার আঁকার সরঞ্জামের মাধ্যমে বিজ্ঞানের জ্ঞান লাভ করে। তাই সৃজনশীল কর্মকান্ড শিশুর কাছে হয়ে ওঠে একটি বড় শিক্ষার মাধ্যম। এই সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে শিশু গড়ে তুলুক তার কল্পনার ভূবন।

প্রবেশদ্বারে যদি লেখা দেখেন ‘এন্ট্রি-রেস্ট্রিক্টেড’ তবে বুঝে নিতে হবে ভিতরে প্রবেশ করতে আপনার যথাযথ অনুমতি প্রয়োজন। বাচ্চাদের মনোজগতটাও কিন্তু অনেকটা এরকমই। তারা যদি চায় তবেই কেবল আপনি পাবেন তাদের জগতে প্রবেশ করার অনুমতি! এক্ষেত্রে শর্তটাও কিন্তু বেশ কড়াকড়ি!

আপনি ভিতরে প্রবেশ করবেন ঠিকই কিন্তু কোন কিছু ওলটপালট করতে পারবেন না, অর্থাৎ তাদের তর্জনীই কিন্তু আপনার পদক্ষেপ নির্ধারণ করবে।

একটা পেন্সিল দিয়ে যেমন অনেকগুলো ‘আ’ লেখা সম্ভব তেমনি এক টানে কিন্তু একটি আমও এঁকে ফেলা সম্ভব। এসব ছোট ছোট পদক্ষেপেই ধীরে ধীরে শুরু হয় বাচ্চাদের সৃজনশীল চর্চা।

বলা হচ্ছে শিশুশিল্পীদের কথা। তাদের আঁকা সেই রঙিন আমটি ঢিল মেরে পেরে খেতে চায় কিছু দুষ্ট বালকের দল। এসবই বাচ্চাদের কল্পজগত। আপনি সেই কল্পজগতে প্রবেশ করলে অতিথি সেজে বড়জোর আমের সুবাসটুকু পাবেন, কিন্তু কোন ভয়ডর দেখিয়ে সেই দুষ্ট ছেলের দল থেকে কাউকে দলছুট করতে পারবেন না।

কিছুদিন আগে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের চিত্রাংকন নিয়ে এক প্রদর্শনী অনুষ্ঠিত হয় ব্র্যাক হেড অফিস, ৭৫ মহাখালি প্রাঙ্গনে। শিক্ষার্থীদের আঁকা ছবিগুলো দেখে আমরা ফিরে যাই সেই শৈশবে। বাস্তব সময়ের চাকা যেখানে প্রতিনিয়ত আমাদের সম্মুখে নিয়ে চলছে, সেখান থেকে বাচ্চাদের আঁকা এই চিত্রগুলোই আমাদের টাইম মেশিনে চড়িয়ে যেন শৈশবে ফিরিয়ে নিয়ে যায়। চোখে কাপড় বেঁধে কানামাছি খেলা, গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য, নৌকাবাইচ কিংবা প্রচন্ড শীতে সূর্যের হালকা চোখ রাঙানো রোদের ছিটেতে আশ্রয় নেওয়া- এ সবকিছুর কথা শিশুরা আমাদের মনে করিয়ে দেয় তাদের তুলির আঁচড়ে।

একজন শিল্পীর বড় শক্তি তার কল্পনার জগত। আগামীকে সে বর্তমানে বসেই ভাবতে শেখে। জল রংয়ের জল এগিয়ে যায় দূর ভবিষ্যতে। শিশুশিল্পীর চিত্রগুলো ঘড়ির কাঁটার মতো। আঙ্গুলের ছোঁয়ায় এই কাঁটাগুলোকে সে পিছনে ঠেলে আপনাকে নিয়ে যাবে অতীতে আবার হয়ত পৌছে দেবে অদেখা ভবিষ্যতের দুয়ারে।

একজন শিশু তার শিল্পের মাধ্যমে বৃত্তের বাইরের কল্পজগতে বিস্তৃতি ঘটায়। সেখানে চিন্তাশক্তি, কল্পনার মিশেল সব আছে যেন ভুরিভুরি। বাংলার রূপ আর ঐতিহ্য সেখানে মাখামাখি। তারা এঁকে চলে মুক্তিকামী বাংলার মানুষ। শত্রু নিধনের চিত্র এঁকে তারা বাঙালী জাতিকে জানান দেয় আমরাই আগামীর দেশ প্রহরী। অধিকার আদায়ে গড়া স্থাপত্য এঁকে এই শিশুরা আমাদের বলে দেয় বাঙালী জাতি সদা ঐক্যবদ্ধ।

শিশুদের চিত্র প্রদর্শনীর ছবিগুলোতে থাকে দেশের প্রতি মায়া ও মমতা। দেশের যা কিছু ভালো সব যেন হাত ছোঁয়া দুরুত্বে সেখানে পাওয়া যায়। পা বাড়ালেই ডিঙি নৌকায় চড়ে নদীর ওপারে যাওয়া, কাঁঠাল গাছে পাকা কাঁঠালে মাছিদের ভনভন শব্দ কানে বাজে! নদীর বাতাসে ঢেউ তোলে ক্ষেতের ফসল। মনে হয় এইতো হাতের কাছেই শহীদ মিনার। হাতটি বাড়িয়ে ফুলের তোড়াটি সম্মান জানায় বীর যোদ্ধাদের। সবই জীবন্ত!

আজ আমাদের দেশে কতজন শিশু একটি নির্দিষ্ট বয়সের পর ছবি আঁকছে ভেবে দেখুন? সচ্ছল, কম সচ্ছল কিংবা সুবিধাবঞ্চিত প্রতিটি শিশুরই রং এর খেলায় হারিয়ে যেতে মন চায়, কিন্তু সেখানে রয়েছে বাস্তবতার চোখরাঙানি। চোখ রাঙানি অভিভাবকদের। শিশুদের শিল্পের জগতটা বন্দি হচ্ছে চার দেয়ালে। টেলিভিশন, কম্পিউটার অথবা কারো বালিশের নীচে লুকিয়ে রাখা থাকে দশ ইঞ্চি ট্যাব! এসব যন্ত্রের ভেতরেই তাদের আজ যত আনন্দ। রং তুলি না পাওয়ার বিড়ম্বনা থেকে হয়তো কম্পিউটারেই এঁকে ফেলছে নদী বা নৌকার দৃশ্য; কিন্তু তুলির আঁচর কি কম্পিউটারের মাউসে সম্ভব? দেয়াল ঘেরা সিমেন্টের আস্তরন কি মাটির গন্ধ এনে দিতে পারবে? শিল্পাচার্য জয়নুল আবেদিন একদা বলেছিলেন, ‘নৌকা আঁকার আগে তুমি নৌকায় চড়ো।’

আগে অনুভব তারপরে না অনুভূতি, কি বলেন! দেয়ালবন্দি শিশুদের দেয়াল ভেঙ্গে বাংলার রূপের কাছে যেতে দিতে হবে। ব্যাগভর্তি বই থেকে একটি বই নামিয়ে যদি একটি স্কেচ খাতা রাখা যায়? বার্গারের বাক্সটির সাথে সাথে কি রংতুলির বাক্সটি রেখে দেয়া সম্ভব? অংকের যোগবিয়োগের পেন্সিলটা যদি লাল-সবুজ রংয়ের হয় তবে কেমন হবে?

শিশুরা বেড়ে উঠুক সৃজনশীল পরিবেশের মধ্য দিয়ে, যারা নেতৃত্ব দেবে ভবিষ্যৎ জগতকে। তাই শিক্ষা অর্থ শুধু কাঁধ বোঝাই বই বুঝলে চলবে না, বরং শিশুর সুষ্ঠ বিনোদন, শিল্পকলার ছোঁয়াও কিন্তু শিক্ষার অংশ।

একজন অভিভাবকের সদিচ্ছা একজন শিশুকে অনেকটা এগিয়ে দেয় এক্ষেত্রে। শিশুরা ছবির মাধ্যমে প্রথম গণিতের শিক্ষা নেয় আবার আঁকার সরঞ্জামের মাধ্যমে বিজ্ঞানের জ্ঞান লাভ করে। তাই সৃজনশীল কর্মকান্ড শিশুর কাছে হয়ে ওঠে একটি বড় শিক্ষার মাধ্যম। এই সৃজনশীলতার মধ্য দিয়ে শিশু গড়ে তুলুক তার কল্পনার ভূবন। আজকের রংয়েই শিশু হয়ে উঠবে আগামীর রঙীন সূর্য। লাল-সবুজকে ছড়িয়ে দেবে তারা বিশ্ব মানচিত্রে।

প্রত্যাশা রইল।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments