যুদ্ধে জয়ী হলাম

July 21, 2020

 আমার এই বিপদের কথা পরিবার ও বাবার কাছে জানাতে পারছিলাম না। আমি বাবার একমাত্র সন্তান। আমার বাবার বয়স ৭৫ বছরের বেশি, একথা জানলে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তারপরও আমি রিজিওনাল ম্যানেজার ভাইকে বলি, আমি সকালে গ্রামে চলে যেতে চাই। ভাই বুঝিয়ে বলেন, এখন পরিবারের সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে বাড়ি যাওয়া উচিত হবে না। এরই মধ্যে জোনাল ম্যানেজার আপা ফোন করে বললেন, ‘আপনি ফুলবাড়ীয়া ব্র্যাক অফিসে আইসোলেশনে থাকবেন। আমি আপনাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছি।’

ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামে কর্মসূচি সংগঠক (পিও) পদে কর্মরত আছেন আবু বাসার। কর্মক্ষেত্র ময়মনসিংহের কেশরগঞ্জ। কোভিড-১৯ মহামারির সম্মুখসারির একজন যোদ্ধা তিনি। এদেশে কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের শুরু থেকেই ব্র্যাকের নানা সচেতনতামূলক কার্যক্রমের সঙ্গে তিনি যুক্ত ছিলেন। এছাড়াও গ্রামের অতিদরিদ্র মানুষদের সচেতন করতে ও প্রয়োজনীয় সহায়তা পৌঁছে দিতে তিনি সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছেন। গত মে মাসে তিনি করোনা আক্রান্ত হন। আসুন জেনে নিই তার করোনা জয়ের গল্প-

লক্ষণ কী ছিল?

দিনটি মনে আছে, ২৮শে মে। আমার হালকা জ্বর ও গলাব্যথা হয়। এরপর আমি হটলাইন নম্বরে ফোন করি এবং তাদের পরামর্শ মতো ওষুধ খাই এবং মাস্ক পরা, বারবার হাত ধোয়া এবং অন্যান্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলি। করোনা খুব ছোঁয়াচে অসুখ। কিছুদিনের মধ্যে আমার জ্বর ও গলাব্যথা ক্রমশ বাড়তে থাকে। আমি আবারও হটলাইন নম্বরে ফোন করি। এবার তারা আমাকে করোনা শনাক্তকরণ পরীক্ষা করতে বলেন।

তখন আমি কী করলাম?

ডাক্তারের পরামর্শের কথা প্রথমেই আমার রিজিওনাল ম্যানেজার ভাইকে জানাই। তিনি আমাকে অভয় দিয়ে পরীক্ষাটি করে নিতে বলেন। প্রথম দিন হাসপাতালে গিয়ে করাতে পারিনি, দ্বিতীয় দিন পরীক্ষার জন্য নমুনা দিয়ে আসি। এবার ফলাফল জানার জন্য অপেক্ষার পালা।

সেদিনই রাত সাড়ে নয়টার দিকে হাসপাতাল থেকে ফোন আসে। আমি তখন রাতের খাবার খাচ্ছিলাম। ফোনের অপর প্রান্ত থেকে বলে, আমি ময়মনসিংহ মেডিকেল থেকে বলছি। তিনি জানান, আমার করোনা টেস্টের ফল পজিটিভ এসেছে।

কীভাবে আমি আক্রান্ত হয়েছি?

আমি গত ঈদুল ফিতরের আগের দিনের কথা বলছি। অফিস থেকে নির্দেশ ছিল, ঈদে কর্মীদের কর্মস্থল ত্যাগ করা যাবে না। সুতরাং আমি পরিবারের সঙ্গে ছুটি কাটাতে যাইনি। বেশ রাতের দিকে পাশের রুমে থাকেন আমারই সহকর্মী, ফোন করে জানান, তিনি করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। দুজন একই ফ্ল্যাটে থাকি তাই আমারও আক্রান্ত হবার আশঙ্কা থাকে, বিশেষত আমরা দুজনেই যেহেতু এক বাথরুম ব্যবহার করি। তিনি আমাকে যথাযথ সতর্কতা মেনে চলার অনুরোধ জানান। তার কথা শুনে করোনা হবার ভয়ে প্রথমে আমি বেশ আতঙ্কিত হয়ে পড়ি। কী করা উচিত তা ভাবতে ভাবতে আমার রিজিওনাল ম্যানেজার ভাইকে ফোন করি। তার পরামর্শে হটলাইন নম্বরে ফোন করলে আমাকে কোয়ারেন্টাইনে থাকতে বলা হয়।

আমার অভিজ্ঞতা

একে ঈদে বাড়ি যেতে পারছি না, আবার করোনা আক্রান্ত হবার ভয়। সব মিলিয়ে মন খারাপ হবে এটাই স্বাভাবিক। তারপর যখন খবর পেলাম রিপোর্ট পজেটিভ এসেছে তখন মনে হলো আমার ওপর যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। কিছুক্ষণ সময় নিলাম নিজে স্থির হতে। এরপর সহকর্মীদের টেস্টের রেজাল্ট জানাই।

সেদিন আমার উর্ধ্বতন সহকর্মী আমাকে অনেক সাহস দিয়ে বলেছিলেন, ‘বাসার আপনি ভাববেন না, পুরো ব্র্যাক পরিবার আপনার সাথে আছে।’ রাতে আমাকে জোনাল ম্যানেজার আপা ফোন করেন। আপা আমাকে অনেক সাহস দেন এবং খোঁজখবর নেন। কিন্তু তারপরও আমি অনেক চিন্তায় পড়ে যাই, এখন আমি কী করব? বেঁচে থাকব তো? আমার পরিবারকে কী জানাব?- এসব নানা কথা ভাবতে থাকি।

আমার এই বিপদের কথা পরিবার ও বাবার কাছে জানাতে পারছিলাম না। আমি বাবার একমাত্র সন্তান। আমার বাবার বয়স ৭৫ বছরের বেশি, একথা জানলে তিনি নিজেই অসুস্থ হয়ে পড়তে পারেন। তারপরও আমি রিজিওনাল ম্যানেজার ভাইকে বলি, ভাই আমি সকালে গ্রামে চলে যাব। ভাই বুঝিয়ে বলেন, এখন পরিবারের সবার নিরাপত্তার কথা ভেবে আপনার বাড়ি যাওয়া উচিত হবে না। এরই মধ্যে জোনাল ম্যানেজার আপা ফোন করে বললেন, ‘আপনি ফুলবাড়ীয়া ব্র্যাক অফিসে আইসোলেশনে থাকবেন। আমি আপনাকে নিয়ে যাবার ব্যবস্থা করছি।’

অফিসের বিভিন্ন সেক্টর থেকে আমাকে ফোন করে অন্য সহকর্মীরাও সাহস দিচ্ছিল বারবার। জানাচ্ছিল তাদের পাশে থাকার কথা। আমার সুস্থতা কামনা করছিলেন তারা। সবার ভরসায় আমি কোভিড-১৯ পজেটিভ হবার কথা পরিবারকে না জানিয়ে ব্র্যাক অফিসে আইসোলেশনে থাকার সিদ্ধান্ত নিই।

এরপর আমি ১৪দিন আইসোলেশনে থাকি। এসময় নিয়মিত হটলাইন নম্বরে যোগাযোগ করে চিকিৎসা ও পরামর্শ নিয়েছি। আমার খাবারের ব্যবস্থা ব্র্যাক থেকেই করা হয়। ১৪ দিন পরে প্রথম ফলোআপে কোভিড-১৯ নেগেটিভ রেজাল্ট আসে। ২য় ফলোআপেও নেগেটিভ রেজাল্ট আসে।

অন্যদের জন্য পরামর্শ

আজ আমি সুস্থ। জুলাই মাসের ৮ তারিখ থেকে আবার আমি অফিসের কাজে যোগ দিই। করোনা মুক্ত হতে দীর্ঘ ২৮ দিন কোয়ারেন্টাইন ও আইসোলেশনে থাকতে হয়েছিল। অসুস্থ থাকাকালে ডাক্তারদের সবধরনের পরামর্শ আমি মেনে চলি। সুস্থ হবার জন্য ওষুধ ও পুষ্টিকর খাবার দুইই প্রয়োজন। সেইসঙ্গে পর্যাপ্ত বিশ্রাম এবং মনোবল থাকা দরকার। রোগ যাতে অন্য কাউকে ছড়াতে না পারে সেজন্য স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।

 

অনুলিখন, সম্পাদনা এবং সমন্বয়: তাজনীন সুলতানা, সুহৃদ স্বাগত এবং উপমা মাহবুব

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments