মায়ের জন্য
ভালোবাসা

May 14, 2018

যে দেশের শ্রমজীবীদের আন্দোলনের ফলে সারা পৃথিবীতে মজুরি বা বেতনভিত্তিক শ্রমের সংস্কৃতিটাই পাল্টে গেছে, সেদেশের নারী শ্রমজীবীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না! মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর মাত্র তিনটি দেশের একটি যেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি বলে কিছু নেই। এ বিষয়ে তার বাকি দুই সঙ্গী হলো পাপুয়া নিউগিনি আর ওমান।

আমার স্কুলের বন্ধু ইতি প্রায় পঁচিশ বছরের ওপর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে থাকে। বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় সে বিদেশ পাড়ি জমিয়েছিল। ও বিয়ে করেছে তা-ও বহু বছর হলো। বিয়ে অনেক আগে করলেও সন্তান নিয়েছে মাত্র কয়েক বছর হলো। অনুমান করি, বিদেশের কঠিন জীবন সংগ্রামে ওরা সন্তান নেওয়ার ফুরসত পায়নি। অনেকদিন যোগাযোগহীন থাকার পর ফেসবুকের কৃপায় ইদানীং আবার যোগাযোগ শুরু হয়েছে।  এর মধ্যে দেশে এলে আড্ডায় মেতেছিলাম একদিন। কথায় কথায় মার্কিন দেশে কর্মজীবী মেয়ে বিশেষ করে যারা সদ্য মা হতে যাচ্ছে কিংবা মা হয়েছে তাদের কষ্টের কথা জেনেছিলাম ওর কাছে। যেটা জানতে পেরে বেশ একটা ধাক্কাই খেয়েছিলাম সেটা হচ্ছে, যুক্তরাষ্ট্রে মাতৃত্বকালীন ছুটির কোনো নির্দিষ্ট আইন নেই!

যে দেশের শ্রমজীবীদের আন্দোলনের ফলে সারা পৃথিবীতে মজুরি বা বেতনভিত্তিক শ্রমের সংস্কৃতিটাই পাল্টে গেছে, সেদেশের নারী শ্রমজীবীরা মাতৃত্বকালীন ছুটি পান না! ১৮৮৬ সালের মে মাসে আমেরিকার শিকাগো শহরে আট ঘণ্টা কর্মদিবসের দাবিতে শ্রমজীবী মানুষের লাগাতার আন্দোলনের ফলে মার্কিন সরকার একসময় তাদের দাবি স্বীকার করে নিতে বাধ্য হয়। পরবতীর্কালে সারা পৃথিবীতে কর্মঘণ্টার এই হিসাব স্বীকৃত হয়েছে। সেই আন্দোলনে নারী শ্রমিকরা বিপুলভাবে অংশ নিয়েছিলেন। শুধু তাই না, তার আগে ও পরেও শ্রমজীবী মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠায় তাঁদের নেতৃত্ব ও অংশগ্রহণ বিপুল।

ফলে সেই আমেরিকায় একবিংশ শতাব্দীতেও মাতৃকালীন ছুটি নেই জেনে আশ্চর্য হতেই হয়। পরে বিষয়টা নিয়ে ইন্টারনেটে কিছুটা ঘাঁটাঘাঁটি করে জানতে পেলাম ফ্যামিলি অ্যান্ড মেডিকেল লিভ অ্যাক্ট বলে ১৯৯৩ সালে সেদেশে একটা আইন হয়েছে, যার বলে কর্মীরা যে-কোনো পারিবারিক ও চিকিৎসাগত প্রয়োজনে ১২ সপ্তাহের ছুটি নিতে পারবেন, তবে সেটা হবে বেতনবিহীন! আরো জানলাম, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পৃথিবীর মাত্র তিনটি দেশের একটি যেখানে মাতৃত্বকালীন ছুটি বলে কিছু নেই। এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বাকি দুই সঙ্গী হলো পাপুয়া নিউগিনি আর ওমান।

মাতৃত্বকালীন ছুটি বিষয়ে মার্কিন দেশের এই করুণ দশা যেখানে, বাংলাদেশের মতো দরিদ্র একটা রাষ্ট্রের কাছে আমরা আর কী-ই বা চাইতে পারি? কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে আর আমাদের মতো গরিব অনেক দেশই অনেক এগিয়ে।

আমাদের শ্রম আইনটির নাম ‘বাংলাদেশ শ্রম আইন ২০০৬’। আইনটির ‘প্রসূতি কল্যাণ সুবিধা’ শীর্ষক চতুর্থ অধ্যায়ের ৪৫ থেকে ৫০ এই ছয়টি ধারায় এ সংক্রান্ত বিশদ বলা আছে। এসব ধারার সংক্ষিপ্ত মর্মার্থ হচ্ছে, এই আইন অনুযায়ী কোনো প্রসূতি সন্তান প্রসবের সম্ভাব্য তারিখের পূর্ববর্তী আট সপ্তাহ এবং সন্তান জন্মের পরবর্তী আট সপ্তাহ সবেতন ছুটি পাবেন। এই সুবিধা তিনি পাবেন যদি ঐ মালিকের অধীনে তিনি কমপক্ষে ছয় মাস কাজ করে থাকেন। তবে যদি ওই প্রসূতির দুই বা ততোধিক সন্তান জীবিত থাকে তাহলে চার মাস সবেতন ছুটির এই সুবিধা তিনি পাবেন না।

আমেরিকা থেকে এ অবস্থা নিঃসন্দেহে অনেক ভালো। কিন্তু একজন প্রসূতি ও তাঁর সন্তানের জন্য কি এ ছুটি যথেষ্ট? এক্ষেত্রে মূল প্রশ্নটি সন্তান ও প্রসূতির কল্যাণকেন্দ্রিক। ব্র্যাকের অ্যাডভোকেসি ফর সোশ্যাল চেইঞ্জ বিভাগ থেকে পরিচালিত একটি প্রকল্পের জন্য কাজ করতে গিয়ে যে বাস্তবতার সঙ্গে পরিচিত হয়েছিলাম তা আমাকে মাতৃত্ব ছুটি নিয়ে আরো গভীরভাবে ভাবতে তাগিদ দিয়েছিল। প্রকল্পটির মূল উদ্দেশ্য ছিল, মাতৃদুগ্ধের বিকল্প বিভিন্ন শিশুখাদ্য বাজারজাত করার বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করার লক্ষ্যে বাংলাদেশের যে আইনটি আছে সে বিষয়ে বিভিন্ন পর্যায়ে সচেতনতা বৃদ্ধি। ওই আইন অনুযায়ী নবজাতক থেকে পাঁচ বছর বয়সীদের ক্ষেত্রে এসব বিকল্প শিশুখাদ্য কেবলমাত্র নির্দিষ্ট শর্তের আওতায় বাজারজাত করা যাবে। যে কেউ চাইলেই এসব খাদ্য উৎপাদন বা বাজারজাত করতে পারবে না। মাতৃদুগ্ধের বিকল্প এসব শিশুখাদ্যকে আমরা সাধারণত কৌটার দুধ, গুঁড়াদুধ ইত্যাদি নামে ডাকি। এই আইনটি প্রণয়নের কারণ আসলে মাতৃদুগ্ধ পানের সামাজিক পরিবেশটিকে  আরো জোরদার করা।

আমরা হয়ত সকলেই জানি, সন্তান জন্মের পর প্রথম ছয় মাস মাতৃদুগ্ধ শিশুর সর্বোত্তম খাবার। শিশুকে এসসময় শুধুমাত্র বুকের দুধ খাওয়ালে তা তার সব ধরনের পুষ্টিচাহিদা মেটায় । ছয় মাস বয়সের পর থেকে শিশুকে ঘরে তৈরি নানা খাবার দেওয়া প্রয়োজন তবে তা মায়ের দুধের পাশাপাশি দিতে হবে। এভাবে শিশুকে অন্তত দুই বছর বয়স পর্যন্ত মাতৃদুগ্ধ পান করালে তার শারীরিক-মানসিক ও আবেগীয় বিকাশ সবচেয়ে ভালো হয়। প্রকল্পটিতে কাজ করতে গিয়ে বাস্তবতার দুটো দিক কাছ থেকে দেখার সুযোগ হলো। একদিকে আইনকে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে শিশুখাদ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো কৌটার খাবারে বাজার সয়লাব করে ফেলেছে। অন্যদিকে, কর্মজীবী মায়েদের এসব খাদ্যের কাছে অসহায় আত্মসমর্পণ। সন্তান জন্মের চার মাসের মধ্যে কাজে যোগ দেওয়ার বাধ্যবাধকতা থেকে অনেকেই আর বাচ্চাকে ছয় মাস পুরোপুরি বুকের দুধ খাওয়াতে পারেন না। কৌটার দুধ তাঁদের কিনতেই হয়। বিশেষ করে শ্রমিক বা নিম্নমধ্য আয়ের শহরবাসী শ্রমজীবী পরিবারগুলোয় এরকম চিত্র অহরহ চোখে পড়েছে।

শুধু সন্তানের স্বাস্থ্য নয়, সন্তান জন্মের আগের শারীরিক ধকল ও সন্তান জন্মের পর লালন-পালনের পরিশ্রমের কারণে মায়ের  বিশ্রাম ও পরিচর্যার দরকার হয়। এসব কারণে মাতৃকালীন ছুটি কমপক্ষে ছয় মাস হওয়া প্রয়োজন। খাত হিসাবে বাংলাদেশে এ সুবিধা রয়েছে শুধুমাত্র সরকারি কর্মচারীদের। সরকারি চাকরিরত নারীরা প্রসূতিকালীন ছয় মাস সবেতন ছুটি পেয়ে থাকেন। সরকার ২০১০ সালে একটি প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য এ সুবিধার কথা ঘোষণা করেন।

কিন্তু সরকারি চাকরিজীবী বা বেসরকারি, সরকারের বড় চাকুরে বা মজুরি শ্রমিক, প্রসূতির পরিপ্রেক্ষিত সব ক্ষেত্রে একইরকম। সকলেরই যত্ন ও পরিচর্যা প্রয়োজন। সব শিশুরই সুস্থভাবে সুস্থ পরিবেশে জন্ম নেওয়ার ও সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার অধিকার আছে। এক্ষেত্রে নিম্নআয়ের পরিবারের মায়েদের আইনগত সুরক্ষা আরো বেশি জরুরি যেহেতু তাঁদের সামাজিক সুরক্ষার অভাব এমনিতেই প্রবল।

অ্যাডভোকেসি বিভাগের প্রকল্পটিতে কাজ করার সময় আমরা বিভিন্ন পর্যায়ে ছয় মাসের সবেতন প্রসূতিকালীন ছুটির প্রয়োজনীয়তা নিয়ে কথা বলেছি। দেশের নাগরিক অধিকার প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় অনেক প্রতিষ্ঠানও এই দাবি তুলেছে। তবে নাগরিক সমাজের পক্ষ থেকে দাবিটি আরো জোরালোভাবে উঠে আসা উচিত যা আইনগতভাবে এ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পথকে সুগম করবে।

বিশ্বের প্রায় সব দেশে নারী দিন দিনই আরো বেশি সংখ্যায় ঘরের বাইরের কর্মক্ষেত্রে যুক্ত হচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে একটি বড় অংশ অন্যের অধীনে বা প্রতিষ্ঠানে মজুরি বা বেতনের বিনিময়ে কাজ করেন। কিন্তু খুব কম দেশেই শ্রমজীবী নারীর কাজের পুরোপুরি উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে, প্রসূতির জন্য পূর্ণাঙ্গ সুবিধা যার একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ। সেই পরিবেশ গড়ে তুলতে আমাদের যেতে হবে আরো অনেক দূর। কর্মজীবী প্রসূতি মায়ের জন্য পর্যাপ্ত সুবিধার আইনগত স্বীকৃতি সে পথে আমাদের এগিয়ে দেবে আরো খানিকটা পথ।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments