মানবতার মঙ্গলের আশায়

May 3, 2020

মহামারির দিনে মানুষের এত ধরনের আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক কষ্ট দেখে নিজের চোখের জল আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে, বারবার মনে পড়ে যায় নিজের কষ্টের কথা। তাও আশায় বুক বাঁধি, নিশ্চয় আমরা সকল প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারব।

করোনাভাইরাস মহামারি আমাদের দেশেও এলো। মানুষের অধিকার রক্ষা আমার মূল কাজ, এবার সাথে যোগ হলো মানুষকে সচেতন করার দায়িত্ব। শুরুতে আমরা, ব্র্যাকের সৈনিকেরা, লিফলেট ও পোস্টার বিতরণ করেছি। চেষ্টা করেছি মানুষের সাথে আন্তরিকভাবে কথা বলে তাদের এই রোগ সম্পর্কে বোঝানোর।

আমি মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইরে ব্র্যাকের মানবাধিকার ও আইন সহায়তা কর্মসূচিতে (HRLS) কর্মরত আছি। বাড়ি ঝিনাইদহ জেলায়। বাবা একজন পঙ্গু মানুষ, বিছানায় পড়ে আছেন প্রায় ২৫ বছর হতে চলল। জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত আমার মা সংসার সামলান। তিন ভাইবোনের মধ্যে আমি সবার বড়ো।

যখন ৭ম শ্রেণিতে পড়ি, তখন আমি অ্যাসিড-সন্ত্রাসের শিকার হই। আমার জীবন ওলটপালট হয়ে যায়। আমি বুঝতে পারি জীবন কতটা কঠিন, কতোটা যন্ত্রণাদায়ক ও ভয়াবহ হতে পারে।

কিন্তু অ্যাসিড আমাকে থামাতে পারেনি। অনেক যুদ্ধ, অনেক সংগ্রাম, অবর্ণনীয় কষ্ট সহ্য করে ২০১৭ সালে মাস্টার্সপাশ করি। পরের বছর ব্র্যাকে যোগ দিই। মনে বিশ্বাস ছিল, অন্য সবাই আমাকে ফিরিয়ে দিতে পারে; কিন্তু ব্র্যাক আমাকে ফিরিয়ে দেবে না।

করোনাভাইরাস নিয়ে মানুষকে সচেতন করার কাজটা সহজ ছিল না। আমাদের এই উদ্যোগের বিরোধিতা করে গ্রামের কিছু মানুষ করোনাকে সরাসরি ‘গুজব’ হিসেবে আখ্যায়িত করলেন। তারা জানতেন না করোনার ক্ষমতা। তখন আমি উপলব্ধি করলাম কীভাবে অনেক সময় আমরা নিজেরাই নিজেদের অমঙ্গল ডেকে আনি! ভুল তথ্য বিশ্বাস করে ডেকে আনি নিজেদের সর্বনাশ।

এক্ষেত্রেও তাই হতে যাচ্ছিল। তারা আমাদের কথা শুনছিলেন না, এলাকায় আমাদের পরিচিতি থাকা সত্ত্বেও পরিবারগুলোকে সচেতন করাটা হয়ে পড়ল অনিশ্চিত। এলাকার অনেক প্রভাবশালী মানুষ বাধা হয়ে দাঁড়ালেন আমাদের সচেতনতা তৈরির চেষ্টায়। তারা পাড়ায়, মহল্লায়, এমনকি ধর্মীয় উপাসনালয়ে বলছিলেন, ‘আমাদের এসব করোনাভাইরাস হবে না। সবাই শুধু শুধু বাড়াবাড়ি করছে।’ এরপর আমরা লকডাউনের ঠিক আগে কয়েকজন মিলে তাদের সাথে কথা বলতে যাই। একসময় তাদেরকে বোঝাতে সক্ষম হই।

দূর্ভাগ্যজনকভাবে কিছুদিনের মধ্যেই করোনায় আক্রান্ত হলেন এলাকার কয়েকজন মানুষ। এবার অন্যেরা বুঝতে পারেন ঘটনা আসলে কী এবং আমাদের প্রচেষ্টার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

গত ৫ই এপ্রিল থেকে পৌর এলাকা লকডাউনে আছে। ব্র্যাক অফিসও তালাবদ্ধ। এলাকার মানুষের সাথে, আমাদের ক্লায়েন্টদের সাথে আমরা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রাখা শুরু করলাম। মাইকে প্রচার করা কুদ্দুস বয়াতির সচেতনতামূলক গান ‘যাইনা চল মাইনা চলরে’ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে সাড়া জাগালো।

আমার বাবা-মা থাকেন আমাদের ঝিনাইদহের বাড়িতে। মা সেদিন ফোনে বলছিলেন, ‘তোমার বাবা তোমাকে নিয়ে চিন্তা করছে। দেশের যেমন অবস্থা, তুমি বাড়ি কবে আসতে পারবে?’ মাকে বললাম, ‘মা, মানুষ এখনও বুঝতে পারছে না করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হবার বিপদ। আবার কাজ বন্ধ হয়ে গেছে বলে অনেকের ঘরে একদানা খাবার পর্যন্ত নেই। এই মানুষগুলোর পাশে আমাদের দাঁড়াতেই হবে। নয়তো তারা তো বুঝবেন না এই মারাত্মক ভাইরাস থেকে কীভাবে বাঁচা যায়’। মাকে বলি আমার জন্য প্রার্থনা করতে। গত ২১ বছর ধরে তার প্রার্থনাই আমার সবচেয়ে বড়ো শক্তি।

নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখেই আমরা কাজ করে যাচ্ছিলাম। আমার টিমের একে অপরের প্রতি সবার রয়েছে সহযোগিতামূলক মনোভাব। দুর্যোগের এই সময় মানুষের কল্যাণে একটি আলাদা অনুভূতি নিয়ে কাজ করছি। দেশের জন্য, মানুষের জন্য কাজ করছি বলেই তো অকপটে বাবা-মা, ভাই-বোন থেকে দূরে থাকার এই ত্যাগ স্বীকার করতে পারি। কবির ভাষায় বললে, ‘আমরা যদি না জাগি মা, কেমনে সকাল হবে’।

১৯৯৯ সালে অ্যাসিডে ঝলসে যাওয়ার পর থেকেই যুদ্ধ করে যাচ্ছি, লড়াইকে তাই আর আমি ভয় পাই না।

লকডাউনের কারণে অনেক বাসার মালিক ভাড়াটিয়াদের কাউকে বাইরে যেতে অনুমতি দিচ্ছেন না। তাই আমিও এই যুদ্ধে যোগ দিয়ে ঘরেই আছি। মাঝে মাঝে মনে কষ্ট হয়, তখন নিজেকে শান্ত রাখি। সব দোকানপাট বন্ধ। কাঁচাবাজার ও নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্র সংগ্রহ হয়ে দাঁড়িয়েছে কষ্টসাধ্য, আর্থিক লেনদেনগুলো হচ্ছে মোবাইলের মাধ্যমে। এলাকার অনেক মানুষ সহায়তার আশায় দিন কাটাচ্ছেন। ক্ষুধাপেটে অপেক্ষা করেন যদি কেউ কোনো সাহায্য করে, মুখে কিছু খাবার তুলে দেয়।

মাঝেমধ্যে আমাদের ক্লায়েন্টরা যোগাযোগ করছেন বিভিন্ন অভিযোগ নিয়ে, পারিবারিক সহিংসতাসহ নানা ধরনের অভিযোগ। তাদের কথা শুনছি, পরামর্শ দিচ্ছি, গুরুতর অভিযোগের ভিত্তিতে মীমাংসাও হয়েছে।

দুই-একদিন আগে আমাদের মানবাধিকার ও আইন শিক্ষা ক্লাসের একজন অংশগ্রহণকারীর ফোন পেলাম। তার বাসার কাছেই একজন বৃদ্ধা না খেয়ে খুব কষ্টে আছেন। শুনে মনটা খারাপ হয়ে গেল। বৃদ্ধার জন্য সাধ্যমতো কিছু চাল ও নগদ টাকার ব্যবস্থা করলাম। বৃদ্ধা খুব খুশি হলেন। সকলের মতো বৃদ্ধাকেও সিংগাইর উপজেলা নির্বাহী অফিসারের করোনা পরিস্থিতি মোকাবেলায় জরুরি খাদ্য, চিকিৎসা ও নিরাপত্তাসংক্রান্ত তথ্য সেবার জন্য হেল্পলাইন নম্বরগুলো (০১৯১৫৯৮৪২০১, ০১৮১৮১৫৮৯৬৮) জানিয়ে দিই।

মহামারির দিনে মানুষের এত ধরনের আর্থিক, সামাজিক, পারিবারিক কষ্ট দেখে নিজের চোখের জল আটকানো কঠিন হয়ে পড়ে, বারবার মনে পড়ে যায় নিজের কষ্টের কথা। তাও আশায় বুক বাঁধি, নিশ্চয় আমরা সকল প্রতিকূলতাকে জয় করতে পারব।

সবশেষে একটি কথা না বললেই নয়। ব্র্র্যাকের মাধ্যমে আমি অ্যাসিড সারভাইভার্স ফাউন্ডেশনে চিকিৎসা পাই। একজন মানবাধিকার কর্মী হিসেবে আমি কাজ করে চলেছি মানবতার মঙ্গলের আশায়। আমাদের সচেতনতায় এবং লড়াইয়ে স্বাভাবিক সময় একদিন ফিরে আসবেই। এই আশায় আমি সুন্দর একটি পৃথিবীর স্বপ্ন আঁকি, যেখানে থাকবে না অসচেতনতা, মহামারি, সহিংসতা।

 

অনুলিখন ও সম্পাদনা: সুহৃদ স্বাগত এবং তাজনীন সুলতানা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments