পুরো মাঠ জুড়ে ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছি। হৈচৈ করছি। সেকি বাধভাঙা আনন্দ! সত্যি, আইসিসি আয়োজিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার যোগ্যতা অর্জন করার বিষয়টি ছিল পুরো বাংলাদেশের জন্য অনেক বড়ো একটি অর্জন। সেই আনন্দ কোনোদিনই ভুলবার নয়।
১৯৯৭ সালের একদিন। আমি তখন নবম শ্রেণিতে পড়ি। স্কুলে আমাদের শ্রেণিকক্ষে রেডিও চলছে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থী সবাই কান পেতে শুনছি। চারপাশে পিনপতন নীরবতা। এক সময় এল সেই সুবর্ণ মুহূর্ত। শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে কেনিয়াকে হারিয়ে বাংলাদেশ ক্রিকেট টিম আইসিসি ট্রফি জিতে গেল। দশম শ্রেণির ভাইয়া-আপুরা বিজয়ের আনন্দে চিৎকার করতে করতে ক্লাসরুম ছেড়ে এক দৌড়ে মাঠে চলে গেল। তাদের দেখাদেখি আমরাও গেলাম। পুরো মাঠ জুড়ে ছেলেমেয়েরা পাগলের মতো দৌড়ে বেড়াচ্ছি। হৈচৈ করছি। সেকি বাধভাঙা আনন্দ! সত্যি, আইসিসি আয়োজিত আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার যোগ্যতা অর্জন করার বিষয়টি ছিল পুরো বাংলাদেশের জন্য অনেক বড়ো একটি অর্জন। সেই আনন্দ কোনোদিনই ভুলবার নয়।
আমরা তো আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলার যোগ্যতা অর্জন করলাম। কিন্তু দুঃখজনকভাবে হলেও সত্য বাংলাদেশ টিম তখন প্রায় সব খেলাতেই হেরে যেত, মাঝেমধ্যে বিশাল ব্যবধানে। কিন্তু তাতে কী, আমি তো ইতিমধ্যে আমার আগের প্রিয় দলগুলোকে সমর্থন করা বাদ দিয়ে দিয়েছি। ক্রিকেটে আমি তখন থেকেই একমাত্র বাংলাদেশেরই সমর্থক। বাংলাদেশের টিমের প্রতিটি খেলার সময় যেন সারা দেশে উৎসব লাগত। ছোটো ফুপু আর আমার মধ্যে বয়সের পার্থক্য অনেক হলেও আমরা ছিলাম বন্ধুর মতো। খেলা দেখতে দেখতে উত্তেজিত হয়ে আমি চিৎকার করতাম, অমুক ভাই কী খেলেন, ছক্কা মারেন। ছোটো ফুপু বলত, ‘এই ‘ভাই’ ডাকিস ক্যান, ‘চাচা’ ডাক!’ প্রায় প্রতিটি খেলা শেষে যদি বাংলাদেশ হেরে যেত তাহলে বাসার সবাই বাংলাদেশ টিমকে নিয়ে কটু কথা বলত। কিন্তু তা সাময়িক, পরেরবার খেলার সময় আবার আশায় বুক বেধে বসতাম। বাংলাদেশকেই সাপোর্ট করতাম।
আমার প্রিয় খেলোয়াড় ছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট আর মোহাম্মদ রফিক। বাংলাদেশ টিম যেহেতু তখন আন্তর্জাতিক ম্যাচের ক্ষেত্রে নবীন, সেহেতু খেলোয়াড়দের অভিজ্ঞতাও কম। কিন্তু পাইলট প্রথম থেকেই আন্তর্জাতিক মানের উইকেট কিপার ছিলেন। দরিদ্র পরিবারের সন্তান মোহাম্মদ রফিক, প্রবল সংগ্রাম করে নিজের যোগ্যতায় বাংলাদেশ জাতীয় দলে জায়গা করে নিয়েছিলেন। সেসময় অধিকাংশ ম্যাচেই বাংলাদেশ টিমের প্রথম সারির ব্যাটসম্যানরা টপাটপ আউট হয়ে যেতেন। আমরা তখন মোহাম্মদ রফিকের আশায় বসে থাকতাম। পাঁচ বা ছয় নম্বর ব্যাটসম্যান হিসেবে তিনি খেলতে নামতেন। কয়েক ওভার খেলে দমাদম চার আর ছক্কা হাঁকিয়ে রানের সংখ্যাকে সম্মানজনক হারের কাছাকাছি নিয়ে তিনি আউট হয়ে যেতেন! তাতেই আমরা মহাখুশি।
আমরা এখন অনেক ভালো খেলি। ক্রিকেট জগতে আমাদের সুনাম আছে। বাংলাদেশ টিমের শক্ত অবস্থান তৈরি হয়েছে। মনে পড়ে, ২০১১ সালে বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত ক্রিকেট বিশ্বকাপে এক শ্বাসরুদ্ধকর ম্যাচে বাংলাদেশ ইংল্যান্ডকে হারিয়েছিল। খেলার ভেন্যু ছিল চট্টগ্রাম। আমার তখন বিয়ে হয়েছে। ঢাকায় থাকি। অনেকদিন পর সেদিন চট্টগ্রামে নিজের বাসায় সবাই মিলে একসঙ্গে খেলা দেখেছিলাম। বাংলাদেশ বনাম ইংল্যান্ডের ম্যাচে সেদিন আমাদেরই জয় হয়েছিল। বাংলাদেশ জিতে যাওয়ায় আমাদের সে কী আনন্দ! শুধু আমরা বলছি কেন জয়ের আনন্দে ভেসেছে পুরো দেশ। চট্টগ্রামবাসীদের তো কথাই নেই। গভীর রাতে গাড়ি নিয়ে কাজিনরা দলবেঁধে রাস্তায়-রাস্তায় ঘুরেছি। দেখেছি মানুষে মানুষে সয়লাব রাস্তা। স্টেডিয়ামের কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম, হাজার-হাজার মানুষ বাংলাদেশ টিম কখন বের হবে সেই আশায় অপেক্ষা আছে। খেলোয়াড়রা যে হোটেলে থাকছেন সেই এলাকায়ও একই অবস্থা। সবাই খেলোয়াড়দের স্বচক্ষে দেখতে চায়, অভিবাদন জানাতে চায়।
বাংলাদেশ টিমের বর্তমান সময়ের খেলোয়াড়রাও কম যান না। সবাই তরুণ, বুদ্ধিমান এবং চৌকশ। বিশ্বের সেরা ক্রিকেটারদের তালিকায় রয়েছে সাকিবের নাম। মাশরাফি তার নেতৃত্ব নিয়ে অন্য এক উচ্চতায় পৌঁছে গেছেন! তারপরও, আমরা যারা বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের আইসিসি ট্রফি জয় থেকে শুরু করে আজকের পাকাপোক্ত অবস্থানে আসার পুরো যাত্রাটির চাক্ষুষ সাক্ষী, তাদের কাছে বাংলাদেশ টিমের প্রতি ভালোবাসার জায়গাটি অনেক গভীর। আজকে যারা খেলোয়াড়দের নিয়ে ট্রল করে, কিংবা টিমের প্রতি আস্থা ধরে রাখতে পারছেন না, তাদের জানাতে চাই অতীতের কথা। সে দিনগুলোর কথা যে পথ বন্ধুর ছিল-আমরা কষ্ট পেয়েছি কিন্তু আশা হারাইনি। বাংলাদেশ ক্রিকেট টিমের উত্থান-পতনের গল্পগুলো সবার জানা উচিত।
ক্রিকেটের সাম্রাজ্য শুধু ছেলেদের দখলে থাকবে, এ যুগে তা সত্যিই অচল। বিশ্বের অন্য দেশের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছে আমাদের দেশ। রুমানা-আয়েশাদের হাত ধরে, এগিয়ে যাচ্ছে নারী ক্রিকেটারদের স্বপ্ন। ভারতকে হারিয়ে সপ্তম এশিয়া কাপ জিতে নিয়েছে বাংলাদেশ মহিলা ক্রিকেট দল।
বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক সমাজের সকল নারী ও পুরুষকে তাদের সম্ভাবনা ও সামর্থ্য বিকাশের লক্ষ্যে কাজ করে চলেছে। ব্র্যাকের কিশোরী ক্লাবের সদস্যরা জীবন ও কর্মমুখী শিক্ষার পাশাপাশি খেলাধুলা ও সাংস্কৃতিকচর্চারও সুযোগ পায়। ক্লাবের মাধ্যমেই খেলোয়াড় হবার স্বপ্ন দেখেছিল নিগার সুলতানা। বর্তমানে সে জাতীয় মহিলা ক্রিকেট দলে উইকেট কিপারের দায়িত্ব পালন করছেন।
তাই পুরনোদের জানাই অসংখ্য ধন্যবাদ আর বর্তমান টিমের জন্য রইল শুভকামনা। মনে রাখতে হবে মাথা উঁচু করে চালাতে হবে লড়াই। আমি দর্শক হিসেবে বলব, হারি আর জিতি, সবসময় বাংলাদেশ দলের সঙ্গেই ছিলাম, আছি এবং থাকব।