মনের শক্তিতে ভেঙেছি অত্যাচারের শিকল

April 5, 2022

যে কয়েকদিন আমার বাসায় ছিল, তখনও তাবাসসুম তার বাবার খারাপ দিকটিই দেখল। কারণ বাড়িতে আসার দুদিন পরই সে মারধোর, ঝগড়া সবই আগের মতো শুরু করে দিল। অবস্থা এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠল যে, এবার আমি বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখনই শুনলাম তার বিরুদ্ধে কী কারণে মামলা হয়েছে।

আমার মেয়ের নাম তাবাসসুম। বয়স প্রায় ১২। সে পড়ালেখায় ভালো, স্কুলের বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় পুরস্কার পায়, স্বভাবে কিছুটা অন্তর্মুখী হলেও যথেষ্ট মিশুক। কিন্তু পরিবার এবং সমাজের একটি চরিত্রকেই তার শুধু ভয়- বাবা।

এই ছোটো বয়সেই সে দেখেছে, তার বাবা টাকার জন্য মাকে বকছে, মারছে। সন্তান যদি দেখে মায়ের ওপর বাবা নামক মানুষটির এই অকথ্য অত্যাচার, তবে তাকে মেনে নিতে কষ্ট হওয়ারই কথা।

বিয়েটা হয়েছিল আমার ইচ্ছের বিরুদ্ধে। ২০১০ সালের কথা।

একে তো মেয়ে তার ওপর বাড়ির বড়ো সন্তান। আমাকে বিয়ে দিয়ে দেওয়ার একটা তাড়া ছিল পরিবারের। যখন ক্লাস সেভেন কি এইটে পড়ি, তখন থেকেই শুনে আসছি ভালো ছেলে পেলে বিয়ে দিয়ে দিব। তারপরও উপযুক্ত বয়সে পরিবারের পছন্দে আমার বিয়ে হয়েছিল।

ছোটো থাকতে বান্ধবীদের বাড়ি যাওয়া নিষেধ ছিল, স্কুলে পড়ালেখা করছি কি না সেদিকে বাবা-মা কখনও নজর দেননি। এমনকি আমার মনে আছে আমাকে স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিতে গিয়েছিলেন আমার মামা। সবার চিন্তা ছিল কবে আমার বিয়ে হবে, কবে আমি বিদায় হব। আত্মীয়স্বজনদের মদদে সৃষ্ট এই উৎপাত আমার সহ্য করতে হয়েছে কারণ আমি ছিলাম নিরুপায়।

আমার বাবা-মা আমাদের চার ভাইবোনকে কড়া শাসনে মানুষ করতে চেয়েছিলেন। রক্ষণশীল মানসিকতার মানুষ হিসেবে যতটুকু করা যায়। তবুও এতো শাসনে ভাইবোনদের সকলেই যে সঠিক পথে ছিল তা বলা যাবে না।  তারা তাদের নিজেদের ব্যবস্থা নিজেরাই করে নিয়েছে।

বিয়ে দেওয়ার সময় একটা মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছিলেন আমার বাবা-মা। পাত্রপক্ষকে বলেছিলেন যে, আমি চাকরি করি না, করতে চাইও না। তাদের ভয় ছিল, বাড়ির বউ চাকরি করবে শুনলে বিয়ে ভেঙে যেতে পারে। অথচ পড়ালেখা আর হাত খরচ জোগানোর জন্য আমি আগে থেকেই চাকরি করতাম। ৩,৮০০ টাকা বেতনে একটি এনজিওতে ততোদিনে আমি থিতু হবার চেষ্টা করছি। কাজেই আমাকে আটকে রাখাও তত সহজ নয়। বিয়ের এক সপ্তাহের মাথায় শ্বশুরবাড়ির বাঁকা চাহনি উপেক্ষা করে আমি ডিগ্রি পরীক্ষায় বসলাম, উত্তীর্ণও হলাম।

কিছুদিন পর থেকে শুরু হলো কারণে-অকারণে জুলুম। আমার ননদের যৌতুকের টাকা বাকি ছিল, সেটি পরিশোধ করা হলো আলমারি থেকে আমার গয়না আর টাকা হাতিয়ে নেওয়ার মাধ্যমে। বাবা সেগুলো দিয়েছিলেন বিয়ের উপহার হিসেবে, যার মূল্যমান প্রায় আড়াই লক্ষ টাকা।

সে তো এক নরক। বাড়ির কারও মধ্যে ভদ্রতার লেশমাত্র নেই, ছেলে গালি দিচ্ছে মাকে, মা পেটাচ্ছে ঘরের বউকে, ননদও সেখানে সরব। সে এক বিচিত্র অবস্থা। সুখের আশা আমি করিনি, তাই বলে পরিবারের ইচ্ছেপূরণে নরকে পা দিচ্ছি সেটিও তো বুঝিনি।

বিয়ের আগে জানতাম বর বাসের ড্রাইভার। পরে জানা গেল হেলপার। মদের নেশায় চূড় হয়ে জানাল, সে বেকার। আমাকে প্রায়ই হুমকি দিয়ে বলত, বেতনের পুরো টাকা তার হাতে তুলে না দিলে আমাকে চাকরি করতে দেবে না। ঘরেই থাকতে হবে। এছাড়া যখন-তখন ঝগড়া, গায়ে হাত তোলা তো ছিল নিত্যকার ঘটনা।

এরই মধ্যে তাবাসসুম আমার গর্ভে এলো। কিন্তু সেদিকেও চাওয়া- ছেলেই হতে হবে। সেইসঙ্গে মধ্যযুগীয় দাবি, ডেলিভারির জন্য হাসপাতালে যাওয়া যাবে না।

আর সহ্য হলো না, সংসার নামক নরক থেকে বেরিয়ে দূরে, নিজের কর্মস্থলের কাছে বাসা নিলাম। ঠিকানা কাউকে জানালাম না।

এগিয়ে এলো সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার মুহূর্ত। বাবার বাড়ির কেউ তখনও জানত না যে আমি স্বামীর বাড়ি ছেড়ে চলে এসেছি। তাই এলাকার এক পরিচিত আপাকে খবর দিয়ে তার সঙ্গে হাসপাতালে গেলাম। স্বামী তখন শুধুই সমাজের সামনে একটি সাইনবোর্ড যেন, পাশে থাকার সঙ্গী নয়। স্বামী থাকলে সমাজ খুশি, না থাকলে লজ্জা।

পথ চলার নতুন সঙ্গী পেলাম, আমার আত্মজা- আমার মেয়ে তাবাসসুম!

মাঝে মাঝে ওকে নিয়েই কাজে যেতাম, ফিল্ড ওয়ার্ক করতাম। সেই প্রজেক্টের সময় শেষ হয়ে গেলে পত্রিকায় বিজ্ঞপ্তি দেখে নতুন চাকরির খোঁজ শুরু করলাম। চট্টগ্রাম শহরে গেলাম ব্র্যাকের নিয়োগ পরীক্ষা দিতে।

 

চাকরি হয়ে গেল। আজ অব্দি প্রায় এগারোটি বছর এই চাকরিটিই আমার জীবনের খুঁটি।

ব্র্যাকে যোগদানের পর আমার নানিকে আমার কাছে এনে রাখলাম। আমি কাজে গেলে আমার শিশু সন্তানের দেখভাল তিনিই করতেন। রোজ সকাল ৮টায় অফিসে যাই, ধীরে ধীরে ফিল্ডে যাওয়া শুরু করলাম। নিজের নামের অধীনে সদস্য সংখ্যা বাড়তে লাগল। এভাবে শিশু সন্তান এবং চাকরি সামলানো অনেক সময়ই কঠিন হয়ে যেত। তবুও আমি মনোবল হারাইনি।

সেসময় বেতনের অর্ধেকের বেশি টাকা চলে যেত বাড়ি ভাড়া দিতে। একটি পরিবারের সঙ্গে সাবলেট থাকতাম। কোনোরকমে দিন কেটে যাচ্ছিল। এরমধ্যে একদিন বাসায় ফিরে দেখি স্বামী এসে হাজির। পরে শুনেছি প্রতিবন্ধী এক নারীকে ধর্ষণ করে সে এখন ফেরারি আসামি। গা ঢাকা দিতেই আমার বাড়িতে আসা।

যে কয়েকদিন আমার বাসায় ছিল, তখনও তাবাসসুম তার বাবার খারাপ দিকটিই দেখল। কারণ বাড়িতে আসার দুদিন পরই সে মারধোর, ঝগড়া সবই আগের মতো শুরু করে দিল। অবস্থা এতটাই অসহনীয় হয়ে উঠল যে, এবার আমি বাবার বাড়িতে কিছুদিন থাকার সিদ্ধান্ত নিলাম। তখনই শুনলাম তার বিরুদ্ধে কী কারণে মামলা হয়েছে। তাই যাবার আগে সেই ধর্ষককে বলে গেলাম পুলিশে খবর দিয়ে তবেই বাবার বাড়ি যাব।

বাবার বাড়ি গিয়ে শুনলাম, সে আমার বাবার কাছেও এসেছিল এবং মেয়ের সংসার বাঁচাতে মরিয়া বাবা সেই ধর্ষককে মামলা থেকে উদ্ধারের জন্য টাকা দিতেও প্রায় রাজি হয়ে যাচ্ছিলেন, কিন্তু যখন বুঝলেন চার্জশিটে তার নাম উঠে গেছে তখন হুঁশ হয় যে আর এগোনো ঠিক হবে না।

এই যন্ত্রণাময় সংসার থেকে আমার মুক্তিতে সবাই যে খুশি হলো তা ভাবলে ভুল হবে। তাবাসসুমের নানা-নানি এবার বলা শুরু করলেন, তোর কপালটাই খারাপ মা, তাই তো তোর বিয়ে টিকল না।

নিজের বাড়িতে ফিরে এসে চাকরিতে মনোযোগ দিই। এর কিছুদিন পর আমার এক পূর্বপরিচিত বন্ধুকে নিজের জীবনসঙ্গী করার সিদ্ধান্ত নিই। নতুন করে সংসার শুরু করি।

এবার আমার সিদ্ধান্ত ভুল হয়নি। তার সহায়তায় নতুন আরও অনেক কিছুর পাশাপাশি আমি বাইক চালাতে শিখে গেলাম। এদিকে ব্র্যাকেও আমার উন্নতি হলো। আমি হলাম ম্যানেজার শাহানা। এখন অফিস থেকে শুরু করে যেখানেই যাই, বাইক চালিয়ে যাই।

 

ব্র্যাকের মতো বৃহৎ প্রতিষ্ঠানের সবচেয়ে সম্মানজনক পুরস্কার- ‘ব্র্যাক মূল্যবোধ পুরস্কার’ পেয়েছি। সেই পুরস্কার আমি গ্রহণ করেছি স্বয়ং আবেদ ভাইয়ের কাছ থেকে। দিনটি আমার জীবনের সবচেয়ে স্মরণীয়।

আমার বাবা আমার কাছে ভয়ের কোনো চরিত্র না হলেও তার কারণে কিন্তু আমাদের কম ভোগান্তি সহ্য করতে হয়নি। তিনি বনবিভাগে চাকরি করতেন। মায়ের সঙ্গে আমরা ভাইবোনেরা চট্টগ্রামে নিজেদের বাড়িতে থাকতাম। এখানে প্রসঙ্গক্রমে বলা ভালো, আমার প্রথম শ্বশুরবাড়িও চট্টগ্রামের মফস্‌সল এলাকায় ছিল। বাবার চাকরির টাকা, বাড়ির আশেপাশে কৃষিকাজ করে কিছু উপার্জন- এ দিয়েই মা সংসার চালাতেন। টাকার ঝামেলায় কখনও পড়তে না হলেও ২০০৩ সালের দিকে আমার বাবা কাউকে কিছু না বলেই আরেকটি বিয়ে করে বসলেন, যেটি আমাদের জীবনে এক অনাকাঙ্ক্ষিত ঝড়ের মতোই এলো।

 

কিছুদিনের মধ্যেই সেই সংসার ত্যাগ করে আবার আমার মায়ের কাছে ফিরে এসেছিলেন বাবা। আমার মা তাকে মেনে নিয়েছিলেন। মা তো মেনে নাও নিতে পারতেন। কিন্তু মেনে নেওয়ার কারণ? ঐ যে বলেছিলাম, সাইনবোর্ড।

 

আমি এখন আগের চেয়ে অনেক ভালো আছি। শুধুমাত্র দুঃখ হলো তাবাসসুম এখনও বাবার অত্যাচারের দৃশ্যগুলো মন থেকে মুছে ফেলতে পারেনি। তাই নতুন বাবার সাথেও তার সম্পর্ক সহজ হয়নি। আমরা দুজনেই চেষ্টা করছি যেন, তাবাসসুমকে এ থেকে বের করে আনতে পারি। এখন তার একজন সঙ্গী হয়েছে, আমার ছোটো ছেলে নাসিফ। দুজনে মিলে যখন হাসে-খেলে-ঘুরে বেড়ায়, তা আমার কাছে পরম শান্তির এক দৃশ্য।

কাজ এবং পরিবারকে প্রাধান্য দিয়ে বয়ে চলুক আমার জীবন, সেখানে আমি চাই শুধু নিজের মতো পথচলার শক্তি। সেইসঙ্গে সন্তানদের আমি আমার মতো করেই বড়ো করতে চাই।

যে পথ আমাকে এতদূর এনেছে তার চড়াই-উতরাই পার হয়েই আমি যেতে চাই সাফল্যের চূড়ায়। আমি ভালো থাকার শপথ নিয়েছি।

 

 

অনুলিখন- সুহৃদ স্বাগত

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা

সাক্ষাৎকার- তানজীম ওয়ালিদ রহমান, তৌসিফ ফরহাদ

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments