ভাষার লড়াইয়ে
বাংলার নারী

February 19, 2020

এই আন্দোলনে পুরুষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থেকেছে নারীর পদচারণা। সচেতনতা, আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া, সংগঠিত করা সবক্ষেত্রেই নারীদের মতপ্রকাশ ও অংশগ্রহণ কোনো অংশে কম ছিল না। সেদিনের বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই দিয়েছে শক্তি, শেষ পর্যন্ত যা আমাদের এনে দিয়েছে লাল-সবুজের পরিচয়।

ভাষা আন্দোলনে নারীদের অবদান নিয়ে কি আমরা যথেষ্ট জানি?

‘আন্দোলনের জন্য প্রয়োজনীয় চাঁদা সংগ্রহ ও পোস্টার লেখাসহ অন্য কাজগুলো তাঁরা করতেন। এসব কাজ করতে গিয়েও তাঁরা ছাত্রদের সঙ্গে সরাসরি কাজ করতে পারেননি। তারপরও তাঁরা আন্দোলন সংগঠিত করার কাজ করেছিলেন। আন্দোলন করতে বেশি ছাত্রছাত্রী লাগবে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সব কটি বিভাগে ৬০-৭০ জনের বেশি ছাত্রী ছিল না। তাই তাঁদের ওপর ভার ছিল ছাত্রী সংগ্রহ করা। তাঁরা দলে দলে ভাগ হয়ে বিভিন্ন স্কুল-কলেজে গিয়ে বুঝিয়ে আন্দোলনের জন্য ছাত্রী সংগ্রহ করতেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের আমতলার সভায় ওই ছাত্রীদের আসতে বলতেন।’

কথাগুলো বলেছিলেন রওশন আরা বাচ্চু। কয়েক বছর আগে প্রথম আলোয় ভাষাসংগ্রামী রওশন আরা বাচ্চুর স্মৃতিকথা নিয়ে ‘আজও জানি না কে ছিল সেই উপকারী মানুষ’ রচনায় লেখিকা নাসরিন আকতার তা উল্লেখ করেন।

প্রথম আলোয় প্রকাশিত একুশের লেখাগুলো পড়তে পড়তে তাঁর রচনাটি আমার নজরে আসে। ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা, তাঁদের প্রত্যয়, তাঁদের বাধা পেরিয়ে এগিয়ে যাওয়ার দৃশ্যটি এ কয়েকটি লাইনে যেন আরও স্পষ্ট হয়ে ওঠে।

১৯৪৭-এ করাচিতে অনুষ্ঠিত জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনের একটি ঘোষণাপত্রে উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্রভাষা হিসেবে সুপারিশ করা হয়। প্রচার মাধ্যম ও বিদ্যালয়ে কেবলমাত্র উর্দু ভাষা ব্যবহারের প্রস্তাব করা হয়। সেদিন প্রতিবাদ ও বিরোধিতা দুই-ই আসে তাৎক্ষণিকভাবে।

ভাষা আন্দোলন দানাবাঁধে তখন থেকেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবেশ থেকে বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা মর্যাদাদানের দাবি জানানো হয়। দাবি আদায়ের লক্ষ্যে গঠন করা হয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদ। ১৯৫২ সালের ২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করার মাধ্যমেই এই আন্দোলনের চরম বহিঃপ্রকাশ ঘটে।

সেসময়ের রক্ষণশীল সমাজে নারীদের চলাফেরার ব্যাপারে ছিল নানা বাধা-নিষেধ। শুনেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছেলেমেয়েরা একসাথে পড়লেও, ছিল ভীষণ কড়াকড়ি। ছেলেদের সঙ্গে কথা বললে হতো জরিমানা। ক্লাস শুরুর আগে মেয়েদের কমন রুমে বসে থাকতে হতো। শিক্ষক ক্লাসে ঢোকার আগে তাদের ডেকে নিয়ে যেতেন। ক্লাসে মেয়েদের বসতে হতো প্রথম সারির বেঞ্চগুলোতে। ক্লাস শেষে শিক্ষকের পিছুপিছু মেয়েদেরকেও বেরিয়ে আসতে হতো।

এরকম একটি পরিস্থিতিতে কোন গণআন্দোলনে যোগ দেওয়া নারীদের পক্ষে সহজ কথা নয়। কিন্তু যখন মায়ের ভাষার ওপর আঘাত আসল, ১৯৪৮ সালে আবার জিন্নাহ যখন ঘোষণা দিলেন, উর্দুই হবে একমাত্র রাষ্ট্রভাষা, বাঙালি তা মেনে নেবে কেন? নারী বা পুরুষ নয়, তখন সবাই প্রতিবাদী জনতা।

ভাষার পক্ষে সবাই হয়ে ওঠে একাট্টা। এই আন্দোলনে পুরুষের সঙ্গে সার্বক্ষণিক থেকেছে নারীর পদচারণা। সচেতনতা, আন্দোলন এগিয়ে নেওয়া, সংগঠিত করা সবক্ষেত্রেই নারীদের মতপ্রকাশ ও অংশগ্রহণ কোনো অংশে কম ছিল না। সেদিনের বাংলাভাষা প্রতিষ্ঠার লড়াই দিয়েছে শক্তি, শেষ পর্যন্ত যা আমাদের এনে দিয়েছে লাল-সবুজের পরিচয়।

ভাষাসংগ্রামে নারীরা কখনও নীরবে কাজ করেছেন, আবার কখনও প্রতিবাদ জানিয়েছেন আন্দোলনের সামনে থেকে। উল্লেখ্য যে, সে সময় শাফিয়া খাতুন ছিলেন উইমেন স্টুডেন্টস ইউনিয়নের সহসভাপতি। তিনি আন্দোলন সংগঠিত করতে বড় ভূমিকা রেখেছিলেন। সুফিয়া আহমেদ, শামসুন্নাহার আহসান, রওশন আরা বাচ্চু, সারা তৈফুর, মাহফিল আরা, খোরশেদী খানম, নাদিরা বেগম, হালিমা খাতুন প্রমুখ নারী একুশের আন্দোলনকে বেগবান করতে কাজ করেছেন।

২১শে ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার ক্ষেত্রে বিতর্ক উঠলে ছাত্রীরা পক্ষে মত দিয়েছিলেন। সেদিন সকাল থেকেই বিভিন্ন স্কুল-কলেজ থেকে মেয়েরা ছোট ছোট দলে ভাগ হয়ে আমতলার সভায় যোগ দিতে এসেছিলেন। পুলিশি হামলার আশঙ্কায় ছাত্রীদের মিছিল না-করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা মাতৃভাষার দাবিতে একই সঙ্গে কণ্ঠ মেলায়। এরপর তো ইতিহাস।

২২শে ফেব্রুয়ারির গায়েবানা জানাজা, শোক মিছিল ও ২৩শে ফেব্রুয়ারির হরতালসহ প্রতিটি কর্মসূচিতে নারীরা অংশগ্রহণ করেছিল। ১৯৫৩ সালে ইডেন কলেজের শিক্ষার্থীরা শহিদ মিনার গড়ে তোলে, যা ইতিহাসের পাতায় অমর। আর বর্তমানে যে কেন্দ্রীয় শহিদ মিনার সেই নকশার সঙ্গে নারী শিল্পী নভেরার নাম স্মরণ করতেই হবে। ঢাকার পাশাপাশি অন্যান্য প্রধান শহর সিলেট, চট্টগ্রাম, বগুড়া, নারায়ণগঞ্জ ইত্যাদি শহরে এই ভাষা আন্দোলন ছড়িয়ে পড়লে সেখানেও নারীদের যথেষ্ট সোচ্চার ভূমিকায় দেখা যায়।

মায়ের ভাষায় কথা বলার অধিকার যেন কেউ কেড়ে নিতে না পারে, দেশ-মায়ের জন্য অকুণ্ঠ ভালোবাসার কথা জানায় আমাদের ভাষা আন্দোলন। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে সকল ভাষাসৈনিক, শহিদ এবং আন্দোলনের কারিগরদের জানাই গভীর শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা।

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
সাবিরা
সাবিরা
4 years ago

ভাষা আন্দোল, মুক্তিযুদ্ধে নারীদের অবদান বরাবরই উপেক্ষিত, এ বিষয়ে লেখার জন্য ধন্যবাদ