কাঁদামাটি মাড়িয়ে, দুৰ্ঘটনা এড়িয়ে, মাস্তানদের গালাগালি সয়ে, সাইকেলে চড়ে ধাক্কা খেয়েও দমে যাননি। শত বাধা সত্ত্বেও গ্রামের মেয়েদের অধিকার আদায়ের জন্য সবসময় পাশে দাঁড়িয়েছেন। তিনি মিতালি ধর, আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক, সুনামগঞ্জ।
মিতালি ধর ১৯৯৩ সালে মাস্টার্স পরীক্ষায় পাস করার পর নিজ জেলা হবিগঞ্জের ব্র্যাক অফিসে যোগদান করেন। তখন ব্র্যাকে চাকরি করলে বাইসাইকেল চালানোর নিয়ম ছিল। কিন্তু সেই এলাকায় মেয়েদের বাইসাইকেল চালানোর রেওয়াজ ছিল না। তাই বাইসাইকেল চালানোটাই ছিল তাঁর বড় চ্যালেঞ্জ। তাঁকে বাইসাইকেল চালাতে দেখলে গ্রামের লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকত, কটু কথা কইত। আবার বর্ষার কাদাপানিতে সাইকেল ঠেলে নেওয়াও ছিল কষ্টসাধ্য। এসব ঝামেলা এড়িয়ে যাবার সহজ সমাধান ছিল চাকরি পরিবর্তন করা। চাইলে তিনি হয়তো তা করতে পারতেন। কিন্তু তিনি তা করেন নি। বরং তিনি সমাজের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন করতে চেয়েছিলেন।
চাকরি পাবার ছয় মাস পর মিতালি বদলি হন মানিকগঞ্জে হাঁসমুরগি ও গবাদি পশু পালন কর্মসূচিতে। একে একে তিনি এর বিভিন্ন শাখা-ইরিগেশন, সেরিকালচার, পোল্ট্রি, ভেজিটেবেল, ফিসারিজ ইত্যদিতে দক্ষতার প্রমাণ রাখেন। চাকরির তিন বছর পর তিনি শেরপুরে বদলি হন। সেখানে তাঁকে ভিন্ন ধরনের বিরূপ পরিস্থিতি মোকাবেলা করতে হয়। শেরপুরের গরুহাটিতে অফিস নেওয়ার পর কয়েকজন মস্তান ছেলে এসে চাঁদা চায়। তারা কর্মীদের ভয় দেখায়, মারধর করবে বলে হুমকি দেয়, ঢিল দিয়ে অফিসের জানালার গ্লাস ভেঙ্গে ফেলে-এ অবস্থা সামাল দিতে মিতালি সেই ছেলেদের অফিসে ডেকে এনে ব্র্যাকের কাজ সম্পর্কে বুঝিয়ে বলেন। বিশেষ করে মেয়েদের উন্নয়নে ব্র্যাক কী কী কাজ করে তা বুঝিয়ে বলার পর ছেলেরা তাদের ভুল বুঝতে পারে। এরপর আর কখনও তারা চাঁদা চাইতে আসেনি।
১৯৯৮ সালে সুনামগঞ্জ জেলার ছাতক উপজেলার গোবিন্দগঞ্জ শাখায়, শাখা ব্যবস্থাপক হিসেবে মিতালি যোগদান করেন। সেসময় সেই শাখার প্রাক্তন ম্যানেজার ও অ্যাকাউনট্যান্টসহ পাঁচজন চাকরিচ্যুত হয়েছিল। ফলে অফিসের কর্মীদের মধ্যে অবিশ্বাস ও অসন্তোষ ছিল। এই অবস্থায় তিনি কর্মীদের কাজের প্রতি আস্থা ফেরাতে এবং সেই শাখার সমস্যাগুলো নিরসনে তিনি নানা উদ্যোগ গ্রহণ করেন। এর কিছুদিন পরে সেই শাখাটি সুনামগঞ্জের সবচেয়ে ভালো শাখা হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিল। সবাই মিলে একত্রে কাজ করলে সফলতা পাওয়া সম্ভব-এটা তারই প্রমাণ।
দুই সন্তান নিয়ে মিতালির সুখের পরিবার। চাকরির কারণে তিনি সুনামগঞ্জে থাকলেও তাঁর স্বামী ও ছেলেমেয়েরা সিলেটে থাকেন। ছুটির দিনগুলো মিতালি পরিবারের সঙ্গে কাটান। পরিবার থেকে দূরে থেকেও তিনি কাজ করতে পারছেন কারণ তিনি মনে করেন ব্র্যাকও তাঁর পরিবারের মতোই। প্রতিনিয়ত সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়া মিতালি মেয়েদের অবস্থার পরিবর্তনে সহায়তা করতে চান। তিনি নিজে স্বাবলম্বী হয়ে এই দৃষ্টান্ত রেখে যেতে চান যে, মেয়েরা চাইলে ঘরে-বাইরের প্রতিটি দায়িত্ব নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করতে পারেন।
২৫ বছর ধরে মিতালি ব্র্যাকের সঙ্গেই আছেন। বর্তমানে তিনি ব্র্যাক সুনামগঞ্জের মাইক্রোফাইন্যান্সের প্রগতি কর্মসূচির আঞ্চলিক ব্যবস্থাপক হিসেবে কর্মরত আছেন। সুনামগঞ্জের ২২টি শাখার ৭০ জন কর্মীর তত্ত্বাবধায়ন করেন। নারীকর্মীদের মনোবল বাড়াতে তিনি সবার কাছে নিজের অভিজ্ঞতা ব্যক্ত করেন। তাদের সাহসী হতে বলেন। কর্মীদের চাকরি বা ব্যক্তিগত জীবনে যে কোনো সমস্যায় সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন।