গত কয়েক বছরের সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ছাড়াও বিপজ্জনক ওভারটেকিং (পাল্লাপাল্লি), সড়ক-মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এছাড়াও রয়েছে যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা এবং সড়কে ছোটো যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি।
৬ই মে ২০১৯ তারিখ সকালবেলা ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ে সোরগোল পড়ে গেল যে, ফোনে আবেদভাইয়ের কণ্ঠ শোনা যাচ্ছে! আবেদভাই ভয়েস এসএমএস পাঠিয়েছেন ব্র্যাককর্মীদের! টানা চতুর্থবার শ্রেষ্ঠ এনজিও-র খেতাব প্রাপ্ত ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা ও চেয়ারপারসন যখন তার পরিবারের সদস্যদের কাছে কোনো বার্তা পাঠান তখন তা নিঃসন্দেহে গুরুত্বপূর্ণ এবং ব্র্যাককর্মীদের কাছে মূল্যবান বক্তব্য হিসেবেই গণ্য হয়। তিনি বললেন, ‘ব্র্যাকের কর্মীদের কাছে আমার অনুরোধ, তোমরা নিজেরা যেমন সড়ক নিরাপত্তার সব নিয়মককানুন মেনে চলবে, তেমনি তোমাদের চারপাশের সব মানুষকে এ বিষয়ে সচেতন করে তুলবে। সবাইকে সড়ক দুর্ঘটনা প্রতিরোধে সক্রিয় ভূমিকা রাখতে অনুরোধ জানাচ্ছি।’ – হ্যাঁ, এভাবেই ব্র্যাককর্মীদের সড়ক নিরাপত্তার বিষয়ে সচেতন করার মাধ্যমে সূচনা হয় পঞ্চম বিশ্ব নিরাপদ সড়ক সপ্তাহ ২০১৯ উদ্যাপন। পুরো সপ্তাহ জুড়েই ব্র্যাকের প্রধান কার্যালয়ের ডিসপ্লে বোর্ডে তাঁর বক্তব্য শোভা পেয়েছিল।
চক্ষুশিবির এবং প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত
ব্র্যাকের সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচি ও জুনিয়র চেম্বার ইন্টারন্যাশনাল ( জেসিআই ) ঢাকা ওয়েস্টের যৌথ উদ্যোগে ঢাকার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনালে দুদিনের চক্ষুশিবির পরিচালিত হয়। সেখানে ১ হাজার ২০০ জনের বেশি চালক ও হেলপারকে চক্ষু পরীক্ষা ও বিনামূল্যে চিকিৎসা সেবা দেওয়া হয়। জাতীয় চক্ষুবিজ্ঞান ইনস্টিটিউট এবং ফ্যাশন অপটিকসের ৩০ জন ডাক্তার ও মেডিকেল অ্যাসিস্ট্যান্ট এই সেবা দেন। পঞ্চম বিশ্ব নিরাপদ সড়ক সপ্তাহের উদ্যাপনের অংশ হিসেবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ)-র সঙ্গে নীতি নির্ধারণী পর্যায়ে অ্যাডভোকেসি সভার আয়োজন করা হয়। আলোচনা সভায় ব্র্যাকের পক্ষ থেকে চক্ষুশিবিরের প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্ত প্রকাশসহ দুর্ঘটনা প্রতিরোধে গাড়িচালকদের চক্ষুসেবায় একটি জাতীয় গাইডলাইন প্রণয়ন করার সুপারিশ প্রদান করা হয়।
চক্ষুশিবিরের সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, ঢাকার বাসচালক ও তাঁদের সহকারীদের (হেলপার) ৫০ শতাংশই চোখের সমস্যায় ভুগছেন। অথচ যারা চক্ষু পরীক্ষা করিয়েছেন সেই বাসচালক ও হেলপারদের ৭২ শতাংশই জীবনে একবারও চোখের ডাক্তারের কাছে যাননি। দুই দিনের চক্ষুশিবিরে যারা চিকিৎসা নিয়েছেন তাদের ৭৬ শতাংশ ব্যক্তিকে চশমা ও ওষুধ দেওয়া হয়। ১২.৬ শতাংশ চালক-হেলপারকে চোখে অস্ত্রোপচারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। চালকের চোখের সমস্যাকে সড়ক দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ হিসেবে উল্লেখ করা হয়। এ অবস্থায় নিয়মিত পরিবহনশ্রমিকদের চোখ পরীক্ষা ও চিকিৎসার উদ্যোগ নেওয়া জরুরি। এ ছাড়াও এই সমীক্ষা থেকে আরও বেরিয়ে আসে যে, বাসচালক ও হেলপারদের ২১ শতাংশই দৈনিক ১২ থেকে ১৬ ঘণ্টা কাজ করেন। এত ঘণ্টা একটানা কাজ করলে সড়ক দুর্ঘটনা ঘটার আশঙ্কা বেশি থাকবেই।
নারী ও মেয়েদের জন্য নিরাপদ হোক সড়ক
সড়কে অব্যবস্থাপনাই বেশিরভাগ দুর্ঘটনার জন্য দায়ী। গত কয়েক বছরের সড়ক দুর্ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, বেপরোয়া গতিতে গাড়ি চালানো ছাড়াও বিপজ্জনক ওভারটেকিং (পাল্লাপাল্লি), সড়ক-মহাসড়কের নির্মাণ ত্রুটি, ফিটনেসবিহীন যানবাহন, অদক্ষ ও লাইসেন্সবিহীন চালক, বিরামহীনভাবে গাড়ি চালানো এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের অভাবে বাড়ছে দুর্ঘটনা। এছাড়াও রয়েছে যাত্রী ও পথচারীদের অসতর্কতা, চলন্ত অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার, রাস্তায় ফুটপাত না থাকা বা ফুটপাত বেদখলে থাকা এবং সড়কে ছোটো যানবাহনের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া ইত্যাদি। ব্র্যাক সড়ক নিরাপত্তা কর্মসূচি সম্প্রতি ‘নারী ও মেয়েদের জন্য নিরাপদ সড়ক’ প্রকল্পের মাধ্যমে নির্ধারিত সড়কে দুর্ঘটনা কমিয়ে আনা ও প্রকল্প এলাকার গণপরিবহনে নারীদের যৌন হয়রানি সম্পূর্ণ বন্ধ করার লক্ষ্যে কাজ করছে। বিশ্ব নিরাপদ সড়ক সপ্তাহ উপলক্ষ্যে এই প্রকল্পের আওতাধীন গাজীপুরের ‘জয়দেবপুর হাই স্কুল’-এ কর্মসূচির কর্মকর্তারা সচেতনতামূলক ক্যাম্পেইন করে। শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের সড়ক নিরাপত্তাবিষয়ে দাবিদাওয়াগুলো স্থানীয় সরকার প্রতিনিধিদের কাছে পৌঁছে দেওয়া হয় যেন বিদ্যমান সমস্যাগুলোর সমাধানে তারা কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ করতে পারেন।
ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুল
২০১১ সাল থেকে ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুল পরিচালনা করছে। গাড়িচালনা শেখানোর পাশাপাশি তারা গাড়িচালকদেরও সড়ক নিরাপত্তা এবং আত্মরক্ষামূলকভাবে গাড়িচালনার প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। বিশ্ব নিরাপদ সড়ক সপ্তাহ উপলক্ষ্যে ব্র্যাক ড্রাইভিং স্কুলের প্রশিক্ষকগণও সচেতনতামূলক কার্যক্রম পরিচালনা করেন এবং বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরেন।
পরিবহন খাতে শৃঙ্খলা আনতে সরকারের বেশ কিছু উদ্যোগ রয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে লেন মেনে গাড়ি চলা, পথচারীদের ফুটপাত, ফুটওভারব্রিজ ও আন্ডারপাস ব্যবহারে উৎসাহিত করা, যত্রতত্র বাস থামিয়ে যাত্রী ওঠানো-নামানো বন্ধ করা, গাড়ি চালানোর সময় সিটবেল্ট বাঁধা বাধ্যতামূলক করা, যানবাহন চালানো অবস্থায় মুঠোফোন ব্যবহার বন্ধ করা এবং একেক দিন একেক এলাকার বিপণিবিতান বন্ধ রাখা ইত্যাদি। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে দেখা যায় নিয়ম না মানার কারণে দুর্ঘটনা ঘটছে। সুতরাং নিয়ম মেনে পথচলা হোক শুরু। সবার জন্য নিরাপদ হোক সড়ক।