বিদেশেও নিরাপদ থাকুক নারীরা

December 9, 2019

ঢাকার উত্তর বাড্ডার এক নারী আমাকে বলেছিলেন, যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, ওই বাসার পুরুষেরা তাঁকে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করত। প্রতিবাদ করলে তাঁর চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হতো।

সৌদিতে গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার, অন্তঃসত্ত্বা হয়ে দেশে ফিরে আসা সেই নারীর কথা শুনবেন? নাকি পিটিয়ে হাত-পা ভেঙে দেওয়া নারীর কথা। গরম আয়রন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া দগ্ধ সেই নারীর আহাজারি? নাকি নির্যাতনের কারণে চারতলার ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে হাসপাতালের আইসিইউতে থাকা মেয়েটির আহাজারির কথা শুনবেন?

সৌদি আরব থেকে নিপীড়িত হয়ে ফেরা এমন নারীদের সংখ্যা বাড়ছে। সৌদি আরবের বাংলাদেশ দূতাবাস এবং গণমাধ্যমের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত চার বছরে নানা ধরনের তিক্ত অভিজ্ঞতা কিংবা আশাভঙ্গের বেদনা নিয়ে ১৩ হাজার নারী দেশে ফিরে এসেছেন। বাড়ছে বিদেশ থেকে আসা নারীদের লাশের সংখ্যাও। গত চার বছরে চারশরও বেশি লাশ এসেছে বিদেশ থেকে।

বিদেশে গিয়ে নারীরা যে ভালো থাকছেন না, সেটা নয়। অনেকেই ভালো থাকছেন। কিন্তু একজন নারীও কেন নিপীড়িত হবেন?

প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৯১ সাল থেকে ২০১৯ সালের অক্টোবর পর্যন্ত আট লাখেরও বেশি নারী বিদেশে গিয়েছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক অর্থাৎ তিন লাখই গেছেন সৌদি আরবে। এছাড়া জর্ডানে দেড়লাখ, আরব আমিরাতে এক লাখ ত্রিশ হাজার, লেবাননে এক লাখ ছয় হাজার, ওমানে ৮৬ হাজার, কাতারে ৩০ হাজার এবং মরিশাসে ১৮ হাজার নারী গেছেন। জর্ডান ও লেবাননে পোশাক কারখানায় কাজ করতে যাওয়া অধিকাংশ মেয়ে ভালো অবস্থায় আছেন, এমন তথ্য নানাভাবেই মিলছে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের অন্য দেশগুলোয় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া অনেকেই নানা সংকটে পড়ছেন। এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সৌদি আরবে।

ঠিক আট বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব যখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী চায় তখন এ ঘটনা নিয়ে ২০১১ সালের ৭ই মে প্রথম আলোতে ‘সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো নিয়ে উদ্বেগ, কয়েকটি দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা, সরকারের নিরাপত্তার আশ্বাস’ শিরোনামে একটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম প্রথম আলোয়।

ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের কারণে এই দেশগুলো যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে দেশটি। কিন্তু নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে বাংলাদেশ সরকারের সেখানে নারী গৃহকর্মী পাঠাতে আপত্তি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশি সায়েদুল হাসান, কুমিল্লার ফরহাদ আহমেদ, চট্টগ্রামের বাবুল আহমেদসহ আরও অনেকেই আমাকে সেদিন বলেছিল, সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের খাদ্দামা বলে। খাদ্দামাদের কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা এখানকার সবাই জানে। কাজেই বাংলাদেশের নারীদের এভাবে নির্যাতনের মুখে পাঠানো ঠিক হবে না।

সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে কী করা হবে জানতে চাইলে তখনকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা বিধান করেই সৌদি আরবে পাঠানো হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’

সেদিন যদি দুশ্চিন্তা করে যথাযথ নিরাপত্তা নেওয়া হতো তাহলে হয়তো পরিস্থিতি আজকের মতো হতো না। তবে এ কথা সত্য প্রথম আলোর ওই নিউজের পর নারীদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি বন্ধ না হলেও কিছুটা গতি হারায়। ততোদিনে কেটেছে আরও চার বছর। ২০০৯ থেকে ২০১৫। ছয় বছর ধরে সৌদি আরবে পুরুষ কর্মী পাঠানো বন্ধ। বাংলাদেশ বারবার অনুরোধ জানাচ্ছে শ্রমবাজারটা ফের চালুর। কিন্তু সৌদি আরব সাফ জানিয়ে দিল, বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী দিতে হবে। নয়তো বাজার খুলবে না।

২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ে উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাইদের নেতৃত্বে ১৯জন সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকায় এল। এবার তারা নারীশ্রমিকদের নেবেই। শ্রম বাজার চালুর জন্য চুক্তি স্বাক্ষর করল বাংলাদেশ। সেদিনও এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা তুলে ধরে খবর প্রকাশ করেছিলাম। ২০১৫ সালের ১১ই ফেব্রুয়ারি ‘৮০০ রিয়ালে নারী গৃহকর্মী, সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির চুক্তি’ শিরোনামে প্রকাশিত হয়েছিল।

ওই প্রতিবেদনে উঠে এসেছিল, ১২০০ থেকে ১৫০০ রিয়াল বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত মাত্র ৮০০ রিয়ালেই (১৬ হাজার ৮০০ টাকা) গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। এত কম বেতনে গৃহকর্মী পাঠানোর চুক্তি করায় এবং নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল সৌদি আরবপ্রবাসী বাংলাদেশিরা।

তাহলে কেন এভাবে নারী পাঠাচ্ছে বাংলাদেশ? সেদিন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, সৌদি আরব দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হয়েছে। কাজেই চাইলেও তাদের প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল না।

ওই চুক্তির পর ২০১৫ সালে গেলেন ২১ হাজার নারী শ্রমিক। ২০১৬ সালে গেলেন ৬৮ হাজার। ২০১৭ সালে গেল ৮৩ হাজার, ২০১৮ সালে ৭৩ হাজার, আর চলতি বছর ৫৩ হাজার। সৌদি আরবে গিয়ে এই নারীরা কেমন থাকলেন?

সৌদিতে থাকা মেয়েদের দুরাবস্থা নিয়ে আবার প্রতিবেদন করলাম, ২০১৬ সালের ৯ এপ্রিল। এবার শিরোনাম, মধ্যপ্রাচ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি মেয়েরা। তখন জানলাম সংসারে সচ্ছলতার আশায় কুড়িগ্রাম থেকে যাওয়া এক নারী সৌদি আরবে গিয়ে গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হন। তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। পরে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেন রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে। দুই মাস পর তিনি দেশে ফিরেন। দূতাবাসের সেই কাগজ আজও আমার কাছে আছে।

ঢাকার উত্তর বাড্ডার এক নারী আমাকে বলেছিলেন, যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, ওই বাসার পুরুষেরা তাঁকে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করত। প্রতিবাদ করলে তাঁর চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হতো। মানিকগঞ্জের এক মেয়ে বলেছেন, সৌদি আরবের বনি ইয়াসার এলাকায় কাজ করতেন তিনি। নির্যাতনের কারণে চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। পরে তার স্থান হয় হাসপাতালের আইসিইউতে। কুমিল্লার এক নারীকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দিলে ১৪টি সেলাই লাগে।

ওই প্রতিবেদনগুলো আজ ইতিহাসের সাক্ষী। প্রথম আলো ছেড়ে ২০১৭ সালের জুলাইতে যোগ দিলাম ব্র্যাকে। ফেরত আসা নারীদের জন্য কাজ করতে গিয়ে শুনলাম নানা নির্যাতনের কথা। দেশে ফেরা নারী গৃহকর্মীদের ভেতর অধিকাংশই অভিযোগ করেছেন যে, সেখানে তারা নিয়োগকর্তা এবং মকতব (সৌদিয়স্থ রিক্রুটিং এজেন্সি)-এর প্রতিনিধি দ্বারা বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়েছেন – শারীরিক, মানসিক এবং যৌন নির্যাতনসহ ঠিকমতো খাবার না পাওয়া, চুক্তি অনুযায়ী নিয়মিত বেতন না পাওয়া এবং নির্ধারিত সময়ের অধিক কাজে নিয়োজিত থাকা ইত্যাদি। সেখানে প্রতিনিয়তই তাদের মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে।

প্রবাসীকল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত সংসদীয় স্থায়ী কমিটির কাছে চলতি বছরের আগস্টে একটি প্রতিবেদন পাঠায় মন্ত্রণালয়। তাতে সৌদি আরব ফেরত ১১০ নারী গৃহকর্মীর ওপর তথ্য দিয়ে বলা হয়, ৩৫ শতাংশ নারী শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়ে দেশে ফিরে এসেছেন। ৪৪ শতাংশ নারীকে নিয়মিত বেতন দেওয়া হতো না।

দেশে ফিরে আসা নারী শ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে মন্ত্রণালয় তাদের ফিরে আসার ১১টি কারণ চিহ্নিত করেছে। মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেরতআসা নারীকর্মীদের মধ্যে ৩৮ জন শারীরিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার হয়েছেন, ৪৮ জন নিয়মিত বেতনভাতা পেতেন না। এছাড়া অন্তত ২৩ জনকে পর্যাপ্ত খাবার দেওয়া হতো না।

মেয়েরা যে শুধু ফিরছে তাই নয়, অনেকে মারাও যাচ্ছে। গত চার বছরে শুধু সৌদি আরব থেকে ১৫৭ জন নারীর মরদেহ দেশে ফিরেছে। দেশে ফেরা ১০৯ নারীর মরদেহের ওপর অনুসন্ধান করে দেখা গেছে আত্মহত্যায় মৃত্যু হয়েছে ২৮ জনের, স্ট্রোকে মারা গেছেন ৪১ জন, দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১৮ জন, খুন হয়েছেন ২ জন।

এসব মৃত্যুর কথা শুনলে মনটা কেঁদে ওঠে। ২০১৭ সালের জুলাই মাসে সৌদি আরবে যান আবিরুন বেগম। চলতি বছরের ১৭ জুলাই নিজ গৃহকর্তার বাসায় মারা যান তিনি। মৃত্যুর ৫১ দিন পর তার পরিবার এ খবর জানতে পারে। পরে ব্র্যাক মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের সহযোগিতায় দূতাবাস ও ওয়েজ আনার্স কল্যাণ বোর্ডের মাধ্যমে তার মরদেহ দেশে আনা হয়। সৌদি আরব থেকে ফিরিয়ে আনা আবিরুনের লাশের সনদে মৃত্যুর কারণ উল্লেখ করা হয় হত্যা। আবিরুনের পরিবারের সদস্যরা জানান, তার নিয়োগকর্তা আবিরুনের ওপর নির্মম নির্যাতন চালিয়ে তাকে মেরে ফেলেছে। এমনকি দুই বছরের কোনো বেতনও তাকে দেওয়া হয়নি।

সৌদি আরবে নির্যাতনে নিহত নাজমার লাশ আসে মৃত্যুর ৫৩ দিন পরে। ২০১৮ সালের ডিসেম্বর মাসে স্থানীয় এক দালালের মাধ্যমে সৌদি আরবে পাড়ি জমান নাজমা। হাসপাতালে ক্লিনারের চাকরি দেওয়ার কথা বলে তাকে পাঠানো হলেও তাকে কাজ দেওয়া হয় বাসাবাড়িতে। সেখানে তাকে যৌন নির্যাতনসহ নানাভাবে নির্যাতন করা হতো। অমানসিক নির্যাতনে নাজমার মৃত্যু হয়েছে বলে দাবি করেছেন তার স্বজনেরা। মৃত্যুর আগে ফোনালাপে নিহত প্রবাসী শ্রমিক নাজমা বলেছিলেন, ‘আমি জায়গায় মরে যামু। আমি আর কুলাতে পারছি না। আমি মরে গেলে তো আমার পোলা মাইয়ার চেহারাও দেখতে পামু না। আল্লাহ্ আমি এখানে কী করমু?” জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত নাজমার আত্মসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার আকুতি ছিল। কিন্তু তিনি দেশে ফিরেছেন লাশ হয়ে।

অনেকে বলার পরে, এই যে তিনলাখ নারী সৌদি আরবে গেল তার মধ্যে মাত্র তো আট/নয় হাজার হাজার জন ফিরেছে। বাকিরা নিশ্চয়ই ভালো আছে। ভালো আছে কী নেই, সেটা জানা যায় না। কারণ সৌদি আরবের সেই বাড়িগুলোতে যাওয়ার অধিকার কারও নেই। সরকার বা দূতাবাসের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থা নেই বললেও চলে। হ্যা অনেক নারী হয়তো ভালো আছেন। কিন্তু যারা নির্যাতিত হয়ে ফিরলেন তাদের কী হবে? আর মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনা তো সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। সৌদি আরবে যদি একটা মেয়েও নির্যাতিত হয়ে কাঁদে সেই কান্না কী পুরো বাংলাদেশের নয়?

প্রায় নিয়মিতভবেই বিমানবন্দরে আমরা মেয়েদের কান্না আমরা শুনি। নির্যাতনের যে বর্ণনা দেন তারা সেগুলো শুনলে গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে যায়। কান্নায় ভিজে যায় চোখ। এই কান্না ইতোমধ্যেই বিমানবন্দর থেকে পৌঁছে গেছে সারাদেশে। এই কান্নার শেষ কোথায়?

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments