মাত্র ১৪ বছর বয়সে তাকে বিয়ে করতে বাধ্য করা হয়। জীবনে কষ্টের, সংগ্রামের অভাব হয়নি কখনও। তাও বেলিয়ারা বেগম বলেন: ‘একটা সময় ছিল যখন আমি জীবনকে শেষ করে দিতে চাইতাম, এখন আমিই বেঁচে থাকতে চাই।’
বেলিয়ারা বেগম দিনাজপুরের খাজিন্দাপাড়ার জগদল গ্রামে থাকেন। তার ৩ ভাই ও ৩ বোন। বড়ো ভাই বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের নির্ভীক সৈনিক। একসময় তারা ভালোই ছিলেন, কিন্তু সবসময় ভালো থাকা গেল না।
বেলিয়ারা তখন সবে কৈশোরে পা রেখেছেন। মায়ের হলো ভীষণ অসুখ। পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে কয়েক মাস রোগে ভুগে মা মারা গেলেন। সংসারে নেমে এলো আঁধার। বাবা আবার বিয়ে করলেন। নতুন মা এসেই বোনদের বিয়ের জন্য ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। একে একে দুই বোনের বিয়ের হলো, কারও বয়সই ১৮ বছর পেরোয়নি।
দুই বোনের পর এবার বেলিয়ারার পালা। তখন তার মাত্র ১৪ বছর বয়স। সৎমা এবং বাবাকে জানিয়েছিলেন তিনি এখনই বিয়ে করতে চান না। কিন্তু তারা সেকথা কানেই তুলল না, মেয়ে দেখাতে নিয়ে এলো দিনাজপুরে। যার সাথে বিয়ে ঠিক করেছে তার বয়স বেলিয়ারার বয়সের দ্বিগুণ, ২৮ বছর। আগের পক্ষের ৪ জন ছেলেমেয়ে আছে। অল্পবয়সি মেয়েকে বিয়ে পড়াতে কাজিসাহেবেরও আপত্তি ছিল। কিন্তু যৌতুক দিতে হবে কম এই অজুহাতে জোরাজুরি শুরু করলেন বেলিয়ারার বাবা। পরিস্থিতির চাপে বেলিয়ারাও আর আপত্তি করতে পারলেন না। সে রাতেই বিয়ের পিঁড়িতে বসতে হলো।
বিয়ের পরপরই বেলিয়ারা পালিয়ে চলে যান বোনের বাড়ি। কিছুক্ষণ পর বাবা আবার সেখান থেকে তাকে ধরে নিয়ে আসে। এই অবস্থায় বোন এবং দুলাভাইও কিছু করতে পারল না। সেসময়ই বেলিয়ারা তার স্বামীকে তালাক দিতে চেয়েছিলেন, কিন্তু তাই কি আর হয়! এ অবস্থা দেখে স্বামী রেগে গিয়েছিল। সেই থেকেই দাম্পত্য জীবনে অশান্তি শুরু হলো।
বিয়ের ৮ বছর পর প্রথম সন্তানের মা হন বেলিয়ারা। প্রথমে ছেলে, এর পাঁচ বছর পর এক মেয়ের মা হন তিনি। বাবার বাড়ি বা স্বামীর বাড়ি কোথাওই ভালো থাকতে পারেন না বেলিয়ারা। একদিকে শ্বশুরবাড়িতে স্বামীর অত্যাচারী মনোভাবের কোনো পরিবর্তন ঘটাতে পারেননি, আবার বাবার বাড়িতে থাকাটা সৎমা ভালো চোখে দেখতেন না, কবে ফিরে যাবে শুধু সে কথাই জিজ্ঞেস করতেন, তাই সেখানেও শান্তি নেই! একবার তো স্বামীর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে পালিয়ে যেতে চেয়েছিলেন পাশের গ্রামে, পারেননি। এরপর স্বামী আরও ভয়ংকর হয়ে উঠেছিল, বেড়েছিল অত্যাচারের মাত্রা।
অভাবের কষ্টও কম কীসের! সেলাই মেশিন বিক্রি, সরিষা খেতে মজুরের কাজ করে একসময় ছেলেমেয়েদের খাবার জোগাড় করতে হয়েছে। দিনাজপুরের বেশি শীতের কথা তো সবারই জানা, থাকেও অনেকদিন। এমন শীতেও তাকে অভাবের কারণে নিজের পোশাক বিক্রি করে দিতে হয়েছিল, ছালা বিছিয়ে থাকতে হয়েছে ছোট্ট কুঁড়েঘরে। কষ্ট সহ্য করতে না পেরে ট্রাক্টরের নিচে পড়ে মরতে চেয়েছিলেন, কোনোরকমে সেবার জীবন বাঁচে।
২০১৩ সালে ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর (বর্তমানে আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন) কর্মসূচির কার্যক্রম তাদের গ্রামে শুরু হয়। কর্মসূচির ব্যবস্থাপক তার কথা শোনেন এবং কর্মসূচির সদস্য করে নেন। এরপর কর্মসূচি থেকে তাকে গৃহপালিত পশু পালনের প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় এবং ৫টি ভেড়া ও ১০টি মুরগি অনুদান হিসেবে কিনে দেওয়া হয়। বেলিয়ারা একেই পুঁজি করে বাঁচার স্বপ্ন দেখেন। উন্নতির আশা নিয়ে সেগুলো ভালোভাবে পালতে থাকে। সুস্থ রাখার জন্য পরামর্শ মতো ওষুধ খাওয়ানো বা টিকা দেওয়া সবই করতেন। পালের পশু সংখ্যা বাড়তে থাকে। এরপর এসব বিক্রির টাকায় সংসারেরও অভাব মিটতে থাকে। এভাবে ২০২০ সালের মধ্যে সে ১৩০টি ভেড়া বিক্রি করেন। সবচেয়ে বেশি লাভ করেছিলেন ২০১৯ সালে।
বেলিয়ারা তার পাড়া-প্রতিবেশীদের বিপদআপদে সবসময়ই পাশে থাকেন। মানুষের প্রতি কাজ করার আগ্রহ দেখে গ্রামের চেয়ারম্যান তাকে ইউনিয়ন পরিষদের কমিশনার পদের জন্য দাঁড়াতে রাজি করালেন। জিততে পারবেন কিনা এ নিয়ে সংশয় থাকলেও দেখা গেল মাইক মার্কা ৩০০০ ভোট বেশি পেয়ে বিপুল ভোটে তিনি জয় লাভ করেছে। ওয়ার্ড কমিশনার হবার পর বেলিয়ারা নিজের আগ্রহেই বাল্যবিবাহ বন্ধের জন্য কাজ করতে শুরু করেন। শুধু নিজের গ্রামে নয়, আশেপাশের গ্রামগুলোতেও বাল্যবিবাহ রোধে সোচ্চার তিনি। যেহেতু গ্রামের নারীরা নির্যাতনের কথা সহজে বলেন না তাই সঠিক তথ্য জানতে এবং পরামর্শের জন্য পারিবারিক সহিংসতা সংক্রান্ত বিচার-সালিশেও চেয়ারম্যান মাঝেমাঝে তাকে তলব করেন।
বেলিয়ারা বেগমের জীবন এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছে। গবাদি পশু ও হাঁস-মুরগি পালার পাশাপাশি সে একটি বিদ্যুৎচালিত অটোরিকশা ভাড়া দেন। তার মেয়েকে গ্র্যাজুয়েশন করার পর বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ের জামাই সবসময় তার ভালোমন্দের খোঁজখবর রাখে। সে জনগণের জন্য কাজ করে যেতে চান। আশা রাখেন একদিন এমপি হবেন এবং দেশে বাল্যবিবাহ রোধ করতে পারবেন। যদিও জানেন এ কাজ সম্পন্ন করা অনেক কঠিন।
একমাত্র অপূরণীয় কষ্ট হলো বাবাকে সাধ্যমতো যতœআত্তি করতে পারেননি। যদিও শেষসময়ে যখন বাবা বিছানায় অসুস্থ হয়ে পড়ে ছিলেন তখন তিনিই দেখভাল করেছেন। কিন্তু আরও সেবা করতে পারলে ভালো লাগত। এখনও বাইনমাছ দেখলে তিনি চোখের পানি আটকাতে পারেন না। এ মাছ যে তার বাবার খুব প্রিয় ছিল!
বাংলাদেশের নারীদের উদ্দেশ্যে কিছু বলতে বলা হলে তিনি বলেন, ‘জীবনে সংগ্রাম থাকবেই। তাকে নিয়ন্ত্রণ করা বা তা থেকে উত্তরণের উপায় নিজেকেই বের করতে হয়। অনেক পেয়েও কিছু হয় না, আবার মাত্র কয়েকটি ভেড়াই জীবনে পরিবর্তন ঘটাতে পারে। একটা সময় ছিল যখন আমি জীবনকে শেষ করে দিতে চাইতাম, এখন আমিই বেঁচে থাকতে চাই।’
বেলিয়ারা বেগম আমাদের সকলের জন্য অনুপ্রেরণা হয়ে থাকবে। ধন্যবাদ ব্র্যাককে অসাধারণ কর্ম সমম্পাদনের জন্য।