ব্যর্থতার বলয় ভেঙ্গে সাফল্য যখন ঘরে আসতে শুরু করে তখন কত মধুর স্মৃতিই না মনে পড়ে। এই মালয়শিয়া থেকে আমাদের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল আইসিসি ট্রফি জেতার মধ্য দিয়ে। তারপর যেন ভোঁজবাজির মতো সব বদলে দিল ক্রিকেট।
মিড উইকেটে বলটি ঠেলে দিয়ে জাহানারা যখন প্রথম রানটি শেষ করে দ্বিতীয় রানের জন্য দৌড় শুরু করলেন, সেখান থেকে তাঁর প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি পায়ের ছাপ যেন বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সাফল্যের দিকেই ছুটছিল! অবশেষে অধরা সেই টি টুয়েন্টি এশিয়া কাপ বাঙালির হাতে এল। এই শিরোপা অর্জনে কিন্তু কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি।
একেবারে তীরে এসে তরি ডুবেছিল পুরুষ দলের ক্ষেত্রে। শুধু এশিয়া কাপ বলব কেন? সম্প্রতি শ্রীলংকায় অনুষ্ঠিত নিদহাস ট্রফিতেও তো ক্রিকেট প্রিয় মানুষ তাদের চোখের জল মুছে ভুলতে চেয়েছে ব্যর্থতা। কিন্তু সে চাইলেই তো আর সাথে সাথে ভোলা যায় না। সফলতা দিয়েই ব্যর্থতাকে ঝেড়ে ফেলতে হয়, আর ঠিক সেই কাজটিই করে দেখাল আমাদের লড়াকু বাঘিনীরা। নিজেদের পাওয়া ট্রফিটি বুঝে নিতে এই টুর্নামেন্টে ফাইনাল ছাড়াও উপমহাদেশীয় ক্রিকেট শক্তি ভারতকে তারা পরাজিত করেছিল শুরুতে আরও একবার। ভারত হারলে অন্যশক্তি পাকিস্তান বাদ যাবে কেন? তাই র্যাংকিংয়ে এগিয়ে থাকা এই দুই ক্রিকেট শক্তিকেই বাংলার নারী ক্রিকেটাররা পরাজিত করল, ব্যবধানটাও কিন্তু ছিল বেশ বড়।
ব্যর্থতার বলয় ভেঙ্গে সাফল্য যখন ঘরে আসতে শুরু করে তখন কত মধুর স্মৃতিই না মনে পড়ে। এই মালয়শিয়া থেকে আমাদের ক্রিকেটের অগ্রযাত্রা শুরু হয়েছিল আইসিসি ট্রফি জেতার মধ্য দিয়ে। তারপর যেন ভোঁজবাজির মতো সব বদলে দিল ক্রিকেট। চায়ের আড্ডা থেকে শুরু করে অফিসের মিটিং, যেখানেই বাঙালি সেখানেই ক্রিকেট! যেখানে বেমালুম উধাও হতে বসল যেন অন্য সব খেলা। যেন ম্যাজিশিয়ানের ফুঁ দেওয়ার মতো এক ফুঁতেই সবার হৃদয়ে জায়গা করে নিল ক্রিকেট।
কিন্তু এ পর্যন্ত পুরো গল্পটাই ছিল পুরুষদের ক্রিকেটকে কেন্দ্র করে। মাঝে মাঝে টুকরো টুকরো বীরত্বের গল্প শোনা গেলেও নারী ক্রিকেট তখনও আলোর মুখ দেখেনি। অবশ্য ভোরের আভা ছড়াচ্ছিল ঠিকই। সেই আলো আজ সূর্যের তীব্র রশ্মি হয়ে ছড়িয়ে দিল বাংলার পথ-প্রান্তর। এই পথচলা কিন্তু মোটেও সহজ ছিল না। একজন নারীকে ক্রিকেটার হতে হলে অনেক কাঁটা বেছানো পথ পেরিয়েই আসতে হয় এবং হয়েছে। পুরুষশাষিত এই সমাজে অনেক রক্তচক্ষু উপেক্ষা করেই একজন নারীকে ক্রিকেটার হতে হয়। সমাজের বাধা, পরিবারের রক্ষণশীলতা কতকিছু পেরিয়ে তবেই-না ক্রিকেট খেলে যাওয়া। অনেককে আবার যুদ্ধ করতে হয় দরিদ্রতার সঙ্গে। আর্থিক প্রতিকূলতাকে সঙ্গী করেই নারী ক্রিকেটারদের পথচলা। তবে কোন অসচ্ছলতা, প্রতিকূলতা, প্রতিবন্ধকতা বা অপ্রতুলতা- কিছুই রুখতে পারেনি বাঘিনীদের হুংকার। তাদের ‘হালুম’ গর্জনে কেঁপে উঠেছে হিমালয় থেকে সুন্দরবন!
বাংলাদেশে নারী ক্রিকেটের শক্ত ভীত গড়তে চাই কংক্রিটের মতো শক্ত ঢালাই, সিমেন্ট বালুর সঠিক সমন্বয়। তাহলেই শুধুমাত্র বহুতল ভবনের মতো সুউচ্চ অবস্থানে পৌঁছাবে নারী ক্রিকেট। ২০০৭ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলা এই নারী দল অন্যান্য পরাশক্তিগুলোর তুলনায় অনেকটাই সুবিধাবঞ্চিত। আকাশে-বাতাসে যে তথ্যটি ভাসছে, তা হলো এখনও নারী ক্রিকেটারদের ম্যাচ ফি খুবই সামান্য। ম্যাচ ফি হিসেবে যা পাচ্ছেন তা অতি নগন্য এবং একটি সম্ভাবনাময় দলের জন্য দুঃখজনক। পাশাপাশি নারী ক্রিকেটে অবকাঠামোগত সুযোগসুবিধা আশানুরূপ নয়। এ বিষয়গুলো নজরদারির মধ্যে আনা জরুরি, নইলে ফল দেওয়া গাছটি দ্রুত মুড়িয়ে যাবে।
প্রতিভা অন্বেষণের মাধ্যমে বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডকে নারী ক্রিকেটারদের আলোতে আনতে হবে। দেশে শক্ত প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ জমজমাট লিগ আয়োজনের মাধ্যমে নারীদের পৃষ্ঠপোষকতা দিতে হবে। বিশ্ব ক্রিকেটে শক্তিশালী দেশগুলোতে পুরুষদলের পাশাপাশি নারী ক্রিকেটের জমকালো আসর বসছে। আমাদের নারী ক্রিকেটে সেই আসরগুলো আয়োজন করতে হবে। এই ক্রিকেট উৎসবের মধ্য দিয়ে আমরা আরও জাহানারা-সালমাদের-নিগারদের খুঁজে পাব। বিসিবির পাশাপাশি খেলোয়াড় তৈরিতে ক্লাব বা অন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে হবে।
বাঘিনীদের যে হুংকার ক্রিকেট বিশ্ব শুনেছে তার আওয়াজ যেন না থামে। নারীরা আজ প্রমাণ করেছে তীরে এসে সব সময় তরি ডুবে যায় না, বরং সমুদ্রের ঢেউয়ের সঙ্গে সঠিকভাবে তরি বেয়ে চললে টানা ছয় বারের বিজয়ী শক্তিশালী প্রতিপক্ষকেও পরাভূত করা সম্ভব। এই বিজয় হোক ক্রিকেটসহ প্রতিটি ক্রিড়াঙ্গনের সাফল্যে বাকবদল। দরকার শুধু একাগ্রতা ও সম্মিলিত প্রয়াস।
নারীর ক্ষমতায়নে বিশ্বাসী এবং নারীদের জন্য দীর্ঘদিন কাজ করতে থাকা একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে ব্র্যাকও এই বিজয়ে অত্যন্ত গর্বিত। আমাদের বাঘিনীরা মাঠ এবং মাঠের বাইরেও ভবিষ্যতে অর্জন করবে আরও অনেক বিজয়, এই আমাদের প্রত্যাশা। মাঠে এবং মাঠের বাইরেও সবার সমর্থন থাকবে তাদের জন্য, এই হোক আমাদের প্রতিজ্ঞা!
ছবিঃ ব্র্যাক ব্যাংক ও ইন্টারনেট