জামালপুর শহরের খালেবিলে প্রতিবছর যে পরিমাণ মানববর্জ্য জমা হয়, তা যদি এক জায়গায় জড়ো করা হয় তাহলে তা হয়তো নিউইয়র্কের এম্পায়ার স্টেট বিল্ডিংয়ের মতো বড়ো বিল্ডিংও কানায় কানায় পূর্ণ করে দেবে। কথাটি অদ্ভুত মনে হলেও এটাই বাস্তব।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের শহর জামালপুরে গত আট বছরে জনসংখ্যা চারগুণের বেশি বেড়েছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার সুবন্দোবস্ত না থাকায় এখানকার পরিবেশ দূষণ বর্তমানে বিপজ্জনক পর্যায়ে পৌঁছেছে। বর্জ্য ব্যবস্থাপনার বিকল্প পদ্ধতি এবং পরিবেশ দূষণ কীভাবে রোধ করা যায় তা নিয়ে স্থানীয় সরকার ও জনগণ উভয়েই নতুন কোনো পন্থা খুঁজছিল।
ব্র্যাক স্থানীয় সরকারের সঙ্গে অংশীদারত্বের ভিত্তিতে ব্যয়সাশ্রয়ী ও টেকসই বর্জ্য ব্যবস্থাপনার কার্যক্রম পরীক্ষামূলকভাবে শুরু করে। এতে স্থানীয় জনগণেরও সাড়া মেলে। ফলে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার পাশাপাশি জৈবসার উৎপাদন কার্যক্রম হয়ে ওঠে আমাদের ইতিবাচক পরিবর্তনের হাতিয়ার। বর্জ্য কীভাবে মানুষের কাজে লাগানো যায় তারই এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হলো ব্র্যাকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা কার্যক্রম।
‘এটিই আমার প্রথম চাকরি। এই চাকরি পাওয়ার আগে আমি বাড়ি বাড়ি গিয়ে লোকেদের জিজ্ঞেস করতাম, আপনাদের পিট/সেপ্টিক ট্যাংক পরিষ্কার করতে হবে কি না? আমি বর্তমানে ব্র্যাকের পিট-অ্যাম্পটিয়ার। স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে পিট পরিষ্কার করার প্রশিক্ষণ নিয়েছি। এখন প্রয়োজনে এলাকার লোকেরা আমাকেই পিট পরিষ্কারের জন্য ডাকে এবং আমার কাজের মর্যাদা দেয়।’ – পণকুমার ভাস্কর, পিট অ্যাম্পটিয়ার।
‘আমি খুব বেশি দূর লেখাপড়া করিনি। আগে ছোটোখাটো-যখন যে কাজ পেতাম তাই করতাম। কিন্তু সবসময়ই মনে হয়েছে, নিয়মিত আয় থাকাটা সংসারের জন্য খুব দরকার। ব্র্যাকের একজন কর্মী একদিন আমাকে সেই সুযোগ করে দিল। তিনি আমাকে ময়লা সংগ্রহের জন্য কিস্তিতে ভ্যান কিনতে ব্র্যাক থেকে ঋণের ব্যবস্থা করে দিলেন। সেই থেকে আমি নিজেই বস, বাড়ি বাড়ি গিয়ে ময়লা-আবর্জনা সংগ্রহ করি। এই কাজে আমার মাসিক আয় হয় ২০ হাজার টাকা। আশা করছি শিগগিরিই ঋণের শেষ কিস্তি পরিশোধ হয়ে যাবে।’ – নূর হোসেন, বাড়ি বাড়ি গিয়ে কঠিন বর্জ্য সংগ্রাহকারী এন্ট্রেপ্রিনিউয়ার।
‘ঢাকায় চাচার বাড়ি বেড়াতে গিয়েছিলাম, সেই বাড়ি থেকে বেরোলেই পথে নাকে রুমাল দিয়ে চলতে হয়। রাস্তাঘাটে খোলা ম্যানহোল তো আছেই, সেইসঙ্গে যেখানে-সেখানে ময়লা-আবর্জনা ফেলা থাকে। জামালপুরে ফিরে আসার পর প্রাণভরে শ্বাস নিলাম। আমি সবসময় চাই আমার চারপাশের পরিবেশ যতদূর সম্ভব পরিষ্কারপরিচ্ছন্ন থাকুক।’ – মোঃ রোকন আলী খান, ছাত্র।
‘একদিন ব্র্যাকের একজন কর্মী আমার কাছে এসে বললেন তিনি আসলে কী বিক্রি করতে চাইছেন এবং এর উপকারিতা কী। শুনে আমি তো অবাক, বলে কী! মানববর্জ্য ও অন্য ময়লা-আবর্জনা থেকে সার তৈরি করেছে! অবিশ্বাস্য মনে হলেও পরীক্ষামূলকভাবে বেগুন খেতে আমি সেই জৈবসার ব্যবহার করি। সে বছর বেগুনের ফলন হয়েছিল অনেক বেশি। বিক্রিও হয়েছিল ভালো। এমনকি পাইকাররা আমার কাছ থেকে আরও বেগুন কিনতে চেয়েছিল।’ – মকবুল হোসেন, কৃষক
মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের লক্ষ্য ছিল কার্যকর বাজারভিত্তিক সমাধান এবং এর চাহিদাকে প্রমাণ করা। প্রয়োজনীয় অবকাঠামো নির্মাণ, স্থানীয় কর্মদক্ষতা বৃদ্ধি ও উদ্ভাবনী কর্মকান্ডের সূচনা – এই তিনটি পর্যায়কে গুরুত্ব দিয়ে জামালপুর মিউনিসিপ্যালিটির প্রশাসনে বিদ্যমান ময়লা-আবর্জনা ব্যবস্থাপনাপদ্ধতিকে আরও উন্নত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়।
এ বছর বিশ্ব টয়লেট ডে-র প্রতিপাদ্য হলো মানববর্জের ক্ষতিকর প্রভাব থেকে পরিবেশকে বাঁচাতে প্রকৃতিভিত্তিক সমাধানগুলো খুঁজে বের করা। বাংলাদেশ স্যানিটেশন ও হাইজিন ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য সাফল্য অর্জন করেছে। এখন মানুষ সচেতন হয়েছে, এখন আর কাউকে খোলা জায়গায় মলমূত্র ত্যাগ করতে দেখা যায় না বললেই চলে। পিট ল্যাট্রিনের ব্যবহার ব্যাপকভাবে বেড়েছে। কিন্তু বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রটি এখনও তেমন উন্নত হয়নি। সুয়ারেজ লাইনের অভাব, যত্রতত্র ময়লা-আবর্জনা ফেলার অভ্যাস এবং উচ্চমাত্রায় পানিদূষণ এখনও আমাদের বড়ো সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে। জামালপুরে ব্র্যাকের বর্জ্য ব্যবস্থাপনা প্রকল্পের সাফল্য এ সমস্যাগুলোর সমাধানে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করা যায়।
পণকুমার এবং নূর হোসেনের নিত্যদিনের কাজ দীর্ঘমেয়াদে সুফল বয়ে আনতে পারে। তাদের পেশাগত সাফল্য এবং প্রকল্পের সফলতা সরকারি-বেসরকারি অংশীদারত্বভিত্তিক সেবার চাহিদা বৃদ্ধি করবে। এর ফলে অন্যরাও প্রয়োজনে ব্র্যাকের মানববর্জ্য ব্যবস্থাপনার মডেল গ্রহণ এবং কর্মকান্ডের বিস্তার ঘটাতে পারে।