বন্যা ২০২২: ডায়েরির পাতা থেকে

July 7, 2022

তখন মাঝরাত। হঠাৎ করেই মাঝির চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। মাহমুদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন কোনো সমস্যা? মাঝি বললেন, তারা যেই এলাকা পাড়ি দিচ্ছেন, সেটি জলদস্যুদের আখড়া এবং প্রায়শই দস্যুরা নৌকাতে আক্রমণ চালায়। ত্রাণ বিতরণ করতে গিয়ে তবে যদি বিপদে পড়তে হয়?

২১শে জুন ২০২২। নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ ব্র্যাক অফিসে ৩ হাজার খাদ্যসামগ্রীর প্যাকেট প্রস্তুত করা হয়েছে। ব্র্যাকের কর্মীরাই হাতে হাতে সব প্যাকেট করেছেন। প্রতিটি প্যাকেটে আছে চিঁড়া, মুড়ি, গুড়, ওরস্যালাইন, মোমবাতি, পানি ও প্রয়োজনীয় ওষুধ। এগুলো সুনামগঞ্জ জেলার তাহেরপুর ও বিশ্বম্ভপুর উপজেলার ৩ হাজার বানভাসি পরিবারের কাছে পৌঁছে দেওয়া হবে। গতকাল একইভাবে ২ হাজার প্যাকেট বিতরণ করা হয়।

যোগাযোগ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় সুনামগঞ্জের বানভাসি মানুষের কাছে ত্রাণসামগ্রী পৌঁছে দেওয়া খুবই চ্যালেঞ্জিং। দেখা গেল, হবিগঞ্জ থেকে সুনামগঞ্জে পৌঁছানোর অপেক্ষাকৃত সহজ একটা পথ আছে। তাই সেখানে একটা বিতরণ কেন্দ্র গড়ে তোলা হলো। কিন্তু প্রয়োজনমতো বিপুল পরিমাণ খাদ্যসামগ্রী পাওয়া সহজ নয়। সেজন্য ভৈরবে চালু করা হলো একটি সাব-সেন্টার। সেখান থেকে বেশি পরিমাণে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করে এনে এখানে মজুত করা হচ্ছে। কুমিল্লা বিএলসি-তে ব্যাকআপ হিসেবে একটি সেন্টার চালু করা হয়েছে। নেত্রকোণা জেলার মোহনগঞ্জ অফিস, হবিগঞ্জের রিজিওনাল অফিসেও খাদ্যসামগ্রী প্যাকেট করার কাজ চলছে পুরোদমে। ময়মনসিংহ বিএলসি-র প্রায় ৮০ জন কর্মী দিনরাত খাদ্য সামগ্রীর প্যাকেট তৈরি করছেন। ময়মনসিংহের শম্ভুগঞ্জেও কাজ চলছে। ব্র্যাকের বিস্তৃত নেটওয়ার্ককে কাজে লাগিয়ে দেশের বিভিন্ন জায়গা থেকে খাদ্যসামগ্রী সংগ্রহ করা হচ্ছে। সবমিলিয়ে বিশাল কর্মযজ্ঞ।

কুমিল্লার ব্র্যাক লার্নিং সেন্টারের অপারেশন ম্যানেজার এস.এম.নাজমুল হক ১৭ই জুন, শুক্রবার, রিক্রুটমেন্ট পরীক্ষার হলে ছিলেন। হঠাৎ বাড়ি থেকে ফোন পেলেন। দুটি খারাপ খবর- তার বাসায় পানি ঢুকছে এবং ছোটোবোনের শরীর খারাপ। বোন গর্ভবতী এবং জরুরিভাবে ময়মনসিংহ মেডিক্যালে নিতে হবে।

“সুপারভাইজার ফোনে সব শুনে বললেন, এক্ষুণি চলে যান। ওদিকে নেত্রকোণার মোহনগঞ্জে  বাসার রাস্তায় পানি। ট্রেন যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। এই অবস্থার মধ্যে বাড়ির লোকেরা বোনকে ময়মনসিংহে নিয়ে এল।” তিনি সেখানে পৌঁছালেন এবং ডাক্তার দেখালেন।

বাসার ভেতরের পানি ক্রমেই বাড়ছে।

কুমিল্লার ডিভিশনাল ম্যানেজার সেই সময় ফোন করে জানালেন, বন্যার্তদের মাঝে বিতরণের জন্য ত্রাণসামগ্রী প্যাকেট হচ্ছে বিএলসির হলরুমে। “মনে হলো, বাসার সমস্যা হয়তো অন্যরা সামলে নিতে পারবে কিন্তু আমার এখন অফিসে থাকা দরকার। ছুটি বাতিল করে আমি চলে এলাম। সবাই মিলে যেভাবে দিনরাত কাজ করছে, সেখানে আমি অংশ নেব না?”

২৬শে জুন। ব্র্যাককর্মীরা শুধু হাওরের জলরাশি আর উত্তাল ঢেউই পাড়ি দিচ্ছেন না, সীমাহীন সাহসিকতার সঙ্গে অসংখ্য সমস্যারও মোকাবিলা করছেন। বানভাসি মানুষের কাছে পৌঁছানোর নিত্যনতুন পথ খুঁজে নিচ্ছেন।

এবিএম মাহমুদ হোসেন সুনামগঞ্জের ধর্মপাশায় ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচিতে কাজ করেন। জরুরি ত্রাণ কার্যক্রম শুরু হলে তিনি স্বেচ্ছায় দায়িত্ব নেন যে, সুনামগঞ্জের দোয়ারাবাজার পর্যন্ত ট্রলারভর্তি মাল তিনিই পৌঁছে দেবেন। শেষ বিকেলে ট্রলার রওনা হয়ে পরদিন ভোরে গিয়ে পৌঁছবে।

তখন মাঝরাত। হঠাৎ করেই মাঝির চোখেমুখে আতঙ্কের ছাপ। মাহমুদ তাকে জিজ্ঞেস করলেন কোনো সমস্যা? মাঝি বললেন, তারা যেই এলাকা পাড়ি দিচ্ছেন, সেটি জলদস্যুদের আখড়া এবং প্রায়শই দস্যুরা নৌকাতে আক্রমণ চালায়।

হঠাৎ করেই তার মাথায় এক বুদ্ধি এলো। তাদের সঙ্গে ব্র্যাকের তিনটি ইমার্জেন্সি ভেস্ট ছিল। তিনি নিজে একটি পরে নিলেন, তার দুই সহকর্মীকে দুটি পরতে বললেন। তারপর তারা তিনজন নৌকার একদম সামনে গিয়ে বসলেন। এরপর টর্চলাইট জ্বালিয়ে এমনভাবে চারপাশে আলো ফেলতে লাগলেন, যেন তারা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য, জলদস্যুদের খুঁজছেন।

দূর থেকে কেউ টর্চের আলো ফেলছিল ব্র্যাকের নৌকার দিকে। নানাদিকে টর্চের আলো ঘুরে যখনই আলো তাদের পিংক ভেস্টের ওপরে পড়ল, সঙ্গেসঙ্গে টর্চের আলো নিভে গেল।

সুনামগঞ্জের ধর্মপাশার অবস্থা বেশ খারাপ। মাইক্রোফাইন্যান্সের অনেক সদস্যই ফোন দিয়ে দুর্দশার কথা জানাচ্ছিলেন। সাবিত্রী সাহা প্রথম যেদিন অবস্থা সরজমিনে দেখতে বের হলেন, লক্ষ্য করলেন অনেকেরই গবাদি পশু পানির স্রোতে ভেসে গেছে, ভেসে গেছে ঘর। আসবাবপত্র কিছুই নেই।

আশ্রয়কেন্দ্রে গিয়ে আরও করুণ অবস্থা চোখে পড়ল। সেখানে খাবারের তীব্র সংকট। যে যেটুকু পেরেছে তা নিয়েই আশ্রয়কেন্দ্রে চলে এসেছে। কিন্তু সঙ্গে করে সেভাবে খাবার আনতে পারেনি।

সাবিত্রী সিদ্ধান্ত নিলেন খাবার কিনে ওদের কাছে পৌঁছতে হবে। এরিয়া ম্যানেজার এবং রিজিওনাল ম্যানেজার ভাইদের সঙ্গে কথা হলো। তাদের পরামর্শে অফিস থেকে টাকা তুলে কেনাকাটায় নেমে পড়লেন। সহকর্মীদের নিয়ে সেগুলো গভীর রাত পর্যন্ত প্যাকেট করলেন। শেষমেষ ১৫০ প্যাকেট হলো।

পরদিন ভোরে চারজন সহকর্মীকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। প্রথমে ট্রাকে করে যতদূর যাওয়া যায় গেলেন। সেখান থেকে নৌকা ভাড়া করে খানুরা, সুনই, বাটগাঁও, বালিজুড়ি, মাইজবাড়ি, শোলক ইত্যাদি এলাকার বাড়ি বাড়ি গিয়ে প্যাকেটগুলো দেওয়া শুরু করলেন। মাইক্রোফাইন্যান্সের অনেক পরিচিত মুখ ও  সদস্যদের কাছেও প্যাকেট পৌঁছল।

ধানোরা প্রাথমিক বিদ্যালয়ের আশ্রয়কেন্দ্র। ১৪টি পরিবার সেখানে আশ্রয় নিয়েছিল। ছেলেমেয়েরা না খেয়ে থেকে একেবারে মলিন মুখ ৷ তাদের কাছে খাবার পৌঁছে দিলাম।

২৫ ও ২৬শে জুন ২০২২ তারিখে সিলেটের সিটি কর্পোরেশন এলাকায় ব্র্যাকের পক্ষ থেকে উচ্চ পুষ্টিগুণসম্পন্ন বিস্কুট বিতরণ কার্যক্রম পরিচালনা করছিলেন রিপন চন্দ্র মণ্ডল। তাদের সঙ্গে সিলেট সিটি কর্পোরেশনের কাউন্সিলররা সহায়তা করায় বিতরণ কার্যক্রম সহজ হয়েছিল।

WFP (ওয়ার্ল্ড ফুড প্রোগ্রাম)-এর পক্ষ থেকে বিতরণকৃত উচ্চ পুষ্টিগুণসম্পন্ন বিস্কুটগুলো ব্র্যাককে দেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য ছিল বন্যাকবলিত এলাকায় যারা পুষ্টিকর খাবার পাচ্ছেন না, তাদের পুষ্টি চাহিদা মেটানো। বিতরণের ক্ষেত্রে শিশু, নারী, অন্তঃসত্ত্বা নারী এবং বুকের দুধ খাওয়াচ্ছেন এমন মায়েদেরকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তালিকা করে সেই তালিকানুযায়ী বিস্কুটের প্যাকেট দেওয়া হয়েছে।

বিস্কুটগুলো খাওয়ার কিছু নিয়ম আছে। মাইকিং করে তারা বারবার সেই নিয়মগুলো সকলকে মনে করিয়ে দিয়েছেন এবং বিতরণের সময়ও বলে দিয়েছেন। তাদেরকে পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটও দেয়া হয়েছিল।

বিস্কুট বিতরণ করে যখন সবকিছু গোছগাছ করছেন, তখন একটি দৃশ্য দেখে তার চোখ আটকে গেল। বিতরণস্থলেই দু’টি শিশু মুখোমুখি বসে বিস্কুট খাচ্ছে আর হাসছে। ওই সময় তাদের পাশে বাবা-মা কেউ নেই। বিস্কুট খেতে দেখে কী যে তৃপ্তি পেলাম, তা ভাষায় প্রকাশ করতে পারেন না রিপন। একটি ছবি মোবাইলে তুলে নিয়ে অফিসে ফিরলেন।

২৯শে জুন। “বানের পানিতে ঘরবাড়ি সব তলাই গেছে। ঘরে মাজা পানি। আমার বউ আর সন্তান দুটোরে নিয়ে কোনোরকমে আশ্রয় নিছি শ্বশুরবাড়িতে। সেইখানেও ঘরের মধ্যে কোমর সমান পানি। কিন্তু কষ্ট হইল গরুগুলানরে বাড়িতে রাখতে পারলাম না। বাড়ি থেকে আসার সময় একটুখানি উঁচু জায়গা দেখে অন্যের সঙ্গে আমার দুটোকেও রেখে আসছিলাম। ভাবছিলাম, গরু দুটোরে থুয়ে কই যাব? কিন্তু শেষমেষ সঙ্গে আনতে পারি নাই।”

সিলেটের কোম্পানিগঞ্জ উপজেলার আতাউর রহমান এভাবেই তার দুর্দশার কথা বর্ণনা করছিলেন। ব্র্যাকের পক্ষ থেকে ত্রাণ পৌঁছে দিতে তার কাছে গিয়েছিলেন তাহমিনা ভূইয়া মিনা।

“আমরা চলে আসার পরেও পানির পরিমাণ যত বাড়তে থাকে, ততই গরুর জন্যও আমার দুশ্চিন্তা বাড়তে থাকে। এই ভয়াবহ বন্যার ৭টি দিন ছিল আমার জীবনের সবচাইতে কঠিন দিন। দুই-তিনদিন না খেয়ে থাকতে হয়েছে। বাধ্য হয়ে বন্যার পানি খাইছি। জীবনে কখনও কল্পনা করি নাই এরকম দুর্দশা আসবে।“

বন্যার পানি নেমে যাওয়ার সঙ্গেসঙ্গে খুব তাড়াহুড়ো করে নিজ বাড়িতে ফিরে এসে প্রথমেই গরু দুটোকে খুঁজতে থাকেন আতাউর। কিন্তু কোথাও তাদের খুঁজে পেলেন না।

আতাউর রহমানের কথা শুনে নির্বাক তাহমীনা। তিনি নিজেও বন্যায় গ্রামে এত পানি আগে কখনও দেখেননি। এখন পানি কমলেও দুর্ভোগ আগের মতোই আছে। আতাউর রহমানকে সান্ত্বনা দেওয়ার মতো ভাষা খুঁজে পাননি।

১৫ দিনের পিতৃত্বকালীন ছুটি নিয়ে কর্মস্থল নেত্রকোণার মোহনগঞ্জ থেকে রওনা হলেন মোঃ হাসান আলী। সেদিন ছিল ১৫ই জুন। বাড়িতে পৌঁছে ডাক্তারের পরামর্শে স্ত্রীকে একটি বেসরকারি নার্সিং হোমে ভর্তি করলেন। সেখানেই সিজারিয়ান অপারেশনের মাধ্যমে জন্ম নিল তার ফুটফুটে মেয়ে সন্তান। সকলেই খুশি।

ছুটিতে এলেও সহকর্মীদের কাছ থেকে বন্যার পানি বাড়ার সব খবর পাচ্ছিলেন। পরিস্থিতির অবনতি হলে ২১শে জুন পরিবার ও সুপারভাইজারের সঙ্গে কথা বলে কর্মস্থলে ফিরে এলেন।

পরদিন সকালে বানভাসি মানুষদের অবস্থা দেখতে গেলেন। চারিদিকে পানি আর পানি। তৎক্ষণাৎ সুপারভাইজারসহ সকলের সঙ্গে আলোচনা করে ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম শুরু করলেন।

বন্যার মতো দুর্যোগে অনেকেই তাদের পালা হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল নিয়ে বিপাকে পড়েন। তাই গবাদিপশু বাঁচিয়ে রাখতে ব্র্যাক আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম হতদরিদ্র পরিবারগুলোর মাঝে উন্নতমানের রেডিফিড বা গোখাদ্য বিতরণের সিদ্ধান্ত নেয়। মোহনগঞ্জ অফিসের পক্ষ থেকে ১৬৪ বস্তা (প্রতি বস্তায় ২৫ কেজি) উচ্চ পুষ্টিমানসম্পন্ন দানাদার (কনসেনট্রেট) গোখাদ্য বিভিন্ন স্পটে বিতরণ করা হয়। বন্যায় ক্ষতিগ্রস্তরা এর সঙ্গে আরও ১৫ কেজি করে সাইলেজ গোখাদ্য পেয়েছেন। সদস্যদের চোখেমুখে তখন আনন্দের ছাপ।

ব্র্যাককর্মীদের চাকরি শুধু চাকরি নয়, তার চাইতেও বেশি কিছু। ভালো থাকুক বানভাসি মানুষ। এই কঠিন পরিস্থিতিতে আমরা মানুষের পাশে আছি, কাছে আছি।

 

গল্প সংগ্রহ এবং সহায়তা- শাহাদাত হোসেন, ইকরামুল কবীর
ফটো ক্রেডিট- সাদিকুর রহমান হিমু, এস.এম.নাজমুল হক, সাবিত্রী সাহা, রিপন চন্দ্র মণ্ডল

5 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments