বন্ধু আমার

July 22, 2018

..অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু হওয়ায় আমরা ছিটকে পড়লাম। আমি চলে গেলাম আগরতলা হয়ে কলকাতায়। সেখানেই, অনেকদিন পরে জানতে পারি, আবেদ বিলেতে চলে গেছে এবং সেখানে সে পুরো সময়টা ব্যয় করছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্রিটিশ জনমতগঠনে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রবাসী বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সমর্থনদানের জন্যে সক্রিয় ভূমিকাপালনে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে আবেদ লন্ডনের ঘরবাড়ি বেচে সেই টাকা দিয়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় এবং ব্র্যাকের প্রথম কমিটিতে সে সুফিয়া কামাল ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতো মানুষকে থাকতে সম্মত করে।

স্যার ফজলে হাসান আবেদকে আমি চিনি তার নাইটহুডের বহু আগে। এই লেখায় তাই তাকে স্যার ফজলে বলে উল্লেখ না করে আবেদ বলেই উল্লেখ করব। ছয় দশকের বেশি আগের কথা। আবেদ তখন ঢাকা কলেজ থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাস করে বিলেতে চার্টার্ড অ্যাকাউনটেন্সি পড়তে যাওয়ার তোড়জোড় করছে। আমি জগন্নাথ কলেজে আইএ দ্বিতীয় বর্ষের ছাত্র। অর্থাৎ সে আমার এক ক্লাসের জ্যেষ্ঠ। আমাদের আলাপ হয় তার খালাতো ভাই খন্দকার আনোয়ার হোসেনের সূত্রে, এই আনু ভাইদের পুরানা পল্টনের বাড়িতে। সে-বাড়ির দ্বার ছিল সকলের জন্যে অবারিত। আমি সে-আড্ডার নিয়মিত অংশীদার, আবেদ সাময়িক অংশগ্রহণকারী।

বিলেত থেকে মনোরথ পূর্ণ করে বেশ একটু দেরিতে ফিরে বহুজাতিক এক কোম্পানির চাকরি নিয়ে আবেদ স্থিতিলাভ করেছে চট্টগ্রামে। ঘটনাক্রমে আমিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্ম ত্যাগ করে যোগ দিয়েছি চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে। এখানে আমাদের আবার যোগাযোগ। তার আমন্ত্রণে বিশ্ববিদ্যালয় আবাসিক এলাকা থেকে আমি সপরিবারে আসতাম তার নাসিরাবাদের বাড়িতে। বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আরও আসতেন ওসমান জামাল-দম্পতি। মাঝেমাঝেই সেখানে সংগীতের আসর বসত। একবার আবেদ ঢাকা থেকে নিয়ে গিয়েছিল খেলনা-বেহালার বাদক ও বিক্রেতা এক অনতিতরুণকে। সে তার বেহালায় নানা সুর তুলেছিল- বিশেষ করে হিন্দি ছায়াছবির জনপ্রিয় গানের। পেটের উপর মাটির সরা বসিয়ে তালবাদ্যের দ্যোতনা তুলেছিল। কেউ কেউ তা উপভোগ করেছিলেন, কেউ কেউ ভেবেছিলেন, করুণা করে আমরা এই স্থূল প্রদর্শনীতে সায় দিচ্ছি। আবেদ আসলে ছেলেটির প্রতিভার কদর করতে চেয়েছিল এবং তাকে খানিকটা আর্থিক সাহায্যও করতে চেয়েছিল।

অচিরেই মুক্তিযুদ্ধের শুরু হওয়ায় আমরা ছিটকে পড়লাম। আমি চলে গেলাম আগরতলা হয়ে কলকাতায়। সেখানেই, অনেকদিন পরে জানতে পারি, আবেদ বিলেতে চলে গেছে এবং সেখানে সে পুরো সময়টা ব্যয় করছে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে ব্রিটিশ জনমতগঠনে এবং মুক্তিযুদ্ধের প্রতি প্রবাসী বাঙালির ঐক্যবদ্ধ সমর্থনদানের জন্যে সক্রিয় ভূমিকাপালনে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয়ের পরে আবেদ লন্ডনের ঘরবাড়ি বেচে সেই টাকা দিয়ে বাস্তুচ্যুত মানুষের পুনর্গঠনের উদ্যোগ নেয় এবং ব্র্যাকের প্রথম কমিটিতে সে সুফিয়া কামাল ও অধ্যাপক আব্দুর রাজ্জাকের মতো মানুষকে থাকতে সম্মত করে। আমি চট্টগ্রাম থেকে এসব বিষয়ে আবছা খবরাখবর পাই।

পরে ঢাকায় যখন আবেদের সঙ্গে আবার যোগাযোগ ঘটে, তখন ব্র্যাক এবং তার প্রতিষ্ঠাতা, দুই-ই আন্তর্জাতিক খ্যাতির অধিকারী। আবেদ আমাকে একদিন বলল, মানিকগঞ্জে গিয়ে ব্র্যাকের স্কুল দেখে এসে আমি যেন এ সম্পর্কে আমার মতামত জানাই তাকে। স্কুল দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ হই। তার শিক্ষার্থীসংখ্যা, শিক্ষার্থীদের উদ্যম, তরুণ শিক্ষিকাদের সাগ্রহ পাঠদান ইত্যাদি সবই কাছের সরকারি প্রাথমিক স্কুলের তুলনায় কিংবা কোনো তুলনার অপেক্ষা না রেখেই বলা যায়, মনোমুগ্ধকর। আমি আবেদকে প্রশংসাবাক্য শোনালাম এবং জানতে চাইলাম এগুলোকে পর্যায়ক্রমে হাইস্কুলে  রূপান্তর করা যায় কি না। সে বলল, দাঁড়াও, আমার মাথায় অন্য একটা চিন্তা ঘুরছে। চিন্তাটা কী, সেকথা তখন সে আমায় বলেনি। কিছুদিন পরে তার অফিস থেকে ফোন এল, আগা খান এডুকেশনাল ফাউন্ডেশনের এক প্রতিনিধি ঢাকায় এসেছেন, আমার পক্ষে কি তাঁর সঙ্গে আলাপ করতে হোটেল শেরাটনে যাওয়া সম্ভব?

গেলাম। সেখানে গিয়েই প্রথম জানলাম, ব্র্যাক একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার কথা চিন্তা করছে। আমার প্রথম প্রতিক্রিয়া এর অনুকূলে ছিল না। আগা খান ফাউন্ডেশনের প্রতিনিধিকে বললাম, বাংলাদেশে যদিও মানসম্পন্ন উচ্চশিক্ষাবিস্তারের আবশ্যকতা রয়েছে, তবু ব্র্র্যাক যদি তাদের স্কুলগুলোকে হাইস্কুল পর্যায়ে নিয়ে যেতে পারে, তাহলে, আমার মতে, বিশ্ববিদ্যালয়-স্থাপনের চেয়ে বেশি দরকারি কাজ করা হবে।

পরে দেখলাম, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি প্রতিষ্ঠিত হলো এবং তার কিছুকাল পরে আবেদ আমাকে ডাকল, তার বোর্ড অব ট্রাস্টির সদস্য হতে। আমি সাড়া দিলাম। সেই থেকে, মানে অনেক কাল ধরে, আমি ওই ট্রাস্টি বোর্ডের সদস্য আছি, উপরন্তু ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির সিন্ডিকেটের সদস্যও হয়ে রয়েছি। আবেদকে একদিন বললাম, ট্রাস্টি বোর্ডে আমার সদস্যপদের মেয়াদ সাধারণ সীমা ছাড়িয়ে গেছে, সেখান থেকে আমার যাওয়ার সময় হয়ে গেছে। আবেদ মৃদু হেসে বলল, তুমি-আমি একসঙ্গে যাব। আমার আর যাওয়া হয়নি।

আবেদ জানে সে কী চায়- তা ব্র্যাক কিংবা ব্র্যাক ইউনিভার্সিটি যা নিয়েই হোক। এতক্ষণে আমরা সবাই জানি, সে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা। তার দেখা স্বপ্নকে সে বাস্তবরূপ দিতে চায়। কীভাবে তা সম্ভবপর হবে, সে-বিষয়েও তার স্পষ্ট ধারণা আছে। তবু সে অন্যদের পরামর্শ চায়- যদি অন্য কারও এমন কোনো ধারণা থাকে যা ওই স্বপ্নের বাস্তবায়নে ফলপ্রসূ হবে, তাহলে সে দুহাতে তা নিতে প্রস্তুত। সে জানে, কোনো কিছুই রাতারাতি অর্জিত হয় না। তাই সে সময় দিতে ও নিতে তৈরি। কিন্তু লক্ষচ্যুত হতে সে রাজি নয়, এ ব্যাপারে আপসরফার প্রশ্নও তার কাছে নেই।

ব্র্যাক আজ শুধু সারা দেশে ছড়িয়ে তা নয়, দেশের বাইরেও কাজ করছে। এশিয়া ও আফ্রিকায় ব্র্যাক সক্রিয়, উত্তর আমেরিকায়ও তার উপস্থিতি রয়েছে। পৃথিবীর সবচাইতে বড় স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা এটি। কী করে তা সম্ভবপর হলো? একজন মানুষের একাগ্রচিত্ততার ফলে তো বটেই, ঠিক লোককে ঠিক জায়গায় বসানোর ব্যাপারে আবেদের যে দক্ষতা তাও এই সিদ্ধির একটা কারণ। ব্র্যাকের সহযোগী প্রতিষ্ঠান ‘আড়ং’ কী বিশাল কর্মযজ্ঞ গড়ে তুলেছে! অনেকে বলেন, আবেদের সাম্রাজ্য ক্রমেই বিস্তৃত হচ্ছে। আবেদ যে নানা দেশ থেকে ঈর্ষণীয় সম্মানলাভ করে চলেছে, সে তো এমনি নয়! ব্র্যাক বহু নারীপুরুষকে তার ভাগ্যের পরিবর্তন ঘটাতে, বহু শিশুকিশোরকে অপ্রত্যাশিত শিক্ষা লাভ করতে সাহায্য করেছে। আবেদ বলবে, ব্র্যাক সহায়ক মাত্র, ওইসব মানুষই চালিকাশক্তি। রবীন্দ্রনাথ মানুষকে আত্মশক্তি উদ্বোধন করতে আহ্বান করেছিলেন। আবেদ তাদের কর্মীবাহিনীকে তাদের পাশে দাঁড়িয়ে থেকে সে-শক্তির উদ্বোধনে সহায়তা করছে।

শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও কর্মশক্তির আবাহনে, নারীর অগ্রযাত্রায়, সমাজের অন্যায় প্রতিরোধে বাংলাদেশের সুবিধাবঞ্চিত মানুষ যা অর্জন করছে, তাতে অংশ নিয়ে একজন স্বপ্নদ্রষ্টা যে তৃপ্তিলাভ করছে, সে-ই তার সেরা পুরস্কার। কল্যাণ হোক তার।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান : ইমেরিটাস অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

‘স্যার ফজলে হাসান আবেদ সংবর্ধনা গ্রন্থ’ হতে সংকলিত

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments