পুরো বাঙালি আজ অপেক্ষায় মাশরাফি ঝলকের। সঙ্গে সাকিবের বাহারি স্ট্রোক, তামিমের ডাউন দ্য উইকেটের সেই সমস্ত গ্যালারি ছাড়ানো ছক্কা। মুশফিক কিংবা মাহমুদুল্লাহর ঠান্ডা মাথার কোনো ইনিংস। সেইসাথে মুস্তাফিজের ধারালো কাটারে প্যাভেলিয়নের পথে বিপক্ষ ব্যাটসম্যান।
১৩ই এপ্রিল ১৯৯৭। পুরো বাংলাদেশের উত্তেজনার পারদ যেন তুঙ্গে। হাতে ছোট্ট লাল রঙের ওয়ান ব্রান্ড রেডিও হাতে ঘুরছে এক কিশোর। অনেকটা এখনকার মোবাইল ফোনের মতো। পুরো দেশজুরে বাংলার মানুষের হাতে হাতে সেই রেডিওই তখন দেশের কণ্ঠস্বর। শেষ বলে জয়ের জন্য প্রয়োজন মাত্র একটি রান। আর এই উত্তেজনা আরও বাড়িয়ে দিয়েছে এই ওভারের প্রথম বলটি বোলারের মাথার ওপর দিয়ে সোজা ছক্কা হাঁকালেন খালেদ মাসুদ পাইলট। তাতেই অনেকটা এগিয়ে যায় বাংলাদেশ। আর শেষ বলটি তো ইতিহাস। হাসিবুল হোসেন শান্তর পায়ে লেগে যখন বলটি ফাইন লেগে চলে গেছে ততক্ষণে ব্যাটসম্যানরা নিজেদের মধ্যে জায়গা বদল করে বাংলাদেশকে প্রথমবারের মতো ওয়াল্ডকাপে পৌঁছে দিয়েছে। সেই কিশোরের মতো বিজয়ের সঙ্গী সমস্ত বাংলাদেশ। বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠল দেশবাসী। অফিসগামী ভদ্রলোকটির সাদা শার্টে কিশোরেরা যখন লাল রঙ মাখিয়ে দিচ্ছে, তখন ভদ্রলোকটিও যেন সেই আনন্দের শামিল। নেই কোনো রাগ, ক্ষোভ, শুধু বাংলাদেশের বিজয় আর বিজয়।
কৈশোর পেরোনো বাংলার ক্রিকেটে এখন লেগেছে তারুণ্যের ছোঁয়া। তারা বিজয়ের রঙে রাঙাতে চাইছে বিশ্ব। ক্রিকেট আমাদের দুহাত ভরে অনেক দিয়েছে। আবার চোখে জলও এনেছে বহুবার। আমরা ক্রিকেটের পরাশক্তি প্রতিটি দেশকে যেমনি হারিয়েছি তেমনি এশিয়া কাপসহ ছয়টি ফাইনালে উঠে হাতছোঁয়া দূরত্বে ট্রফিটিকে রেখে বাংলাদেশকে কাঁদতে দেখেছে ক্রিকেট বিশ্ব। চোখের জল আমাদের চোখকে করেছে আরও উজ্জ্বল। বাংলাদেশ এখন সেই চোখেই জয়ের স্বপ্ন দেখে। ক্রিকেট মানেই বাঙালির কাছে উৎসব। আর সেটা যদি হয় বিশ্বকাপ তাহলে তো কথাই নেই। পুরো জাতি তখন ক্রিকেট উন্মাদ।
১৯৮৬ বাংলাদেশের প্রথম ওয়ানডে ডেবু শুরুর বছর। একটু সময় নিয়ে ১৯৯৯ এর প্রথম বিশ্বকাপে পা রাখা। ক্রিকেট ওয়াল্ডকাপের সেই আসরের রানার আপ হওয়া পাকিস্তানকে হারিয়ে বাংলাদেশের পরাশক্তির বধ শুরু। এরপর ক্রিকেট চাকা আরও দ্রুত চলতে শুরু করল। ২০০৭-এর ওয়াল্ড কাপে এসে বাংলাদেশ উঠে এল সুপার এইটে। এবারে ধরাশায়ী বিশ্বক্রিকেটের শিরোপা প্রত্যাশী ভারত ও দক্ষিণ আফ্রিকা। ২০১৫ ওয়াল্ড কাপ উন্নতির আরও এক ধাপ। এবারে কোয়াটার ফাইনালে বাংলাদেশ। এই পথে আসতে রুবেলে সেই বিধ্বংসী স্পেল কিংবা মাহমুদুল্লার ব্যাক টু ব্যাক সেঞ্চুরি। আহা…
সদ্য শেষ হলো আয়ারল্যান্ডে ত্রিদেশী সিরিজ। চ্যাম্পিয়ন বাংলাদেশ। এ সুখস্মৃতি নিয়েই বাংলাদেশ পা রাখছে বিশ্ব ক্রিকেটের মহাআসরে। ওয়াল্ড কাপ ২০১৯ এখন দুয়ারে। পুরো বাঙালি আজ অপেক্ষায় মাশরাফি ঝলকের। সঙ্গে সাকিবের বাহারি স্ট্রোক, তামিমের ডাউন দ্য উইকেটের সেই সমস্ত গ্যালারি ছাড়ানো ছক্কা। মুশফিক কিংবা মাহমুদুল্লাহর ঠান্ডা মাথার কোনো ইনিংস। সেইসাথে মুস্তাফিজের ধারালো কাটারে প্যাভেলিয়নের পথে বিপক্ষ ব্যাটসম্যান।
বাংলাদেশের ক্রিকেট সাফল্য সব সময় সমগ্র দেশবাসীকেই অনুপ্রাণিত করে। হোক সেটা ছেলে অথবা মেয়েদের সাফল্য। ক্রিকেট আজ সবার, সেটা শুধু পুরুষদের জন্যই নয় বরং মেয়েরাও এখন আমাদের ক্রিকেট সাফল্য এনে দিচ্ছে। একথা আমাদের ভুলে গেলে চলবে না যে, বাংলাদেশের ক্রিকেটের সর্বোচ্চ সাফল্য এশিয়া কাপ এই বাঘিনীদের হাত ধরেই এসেছে। তাই সাফল্য সব সময় একে অপরের হাত ধরেই এগিয়ে নিতে হয়। একজন সন্তান যখন সামনে এগিয়ে চলে তার দুটি হাত যেন বাবা-মায়ের হাতের বন্ধনেই আবদ্ধ থাকে। আর ক্রিকেট বাংলাদেশের কাছে তো সন্তান তূল্য।
ক্রিকেট বাংলাদেশকে বিশ্বসভায় পরিচিতি দিয়েছে। তাই বাংলাদেশের বিজয় আমরা সব সময় চাইব। কিন্তু এই চাওয়া পাওয়াতে আমাদের আবেগকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। সাফল্য আসবেই তবে সেটা সুনির্দিষ্ট পথ ধরে, ততদিন আমাদেরকে হতে হবে বাস্তববাদী। বিশ্বকাপ চলাকালীন আমাদেরকে আবেগ নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে। অহেতুক অন্যদেশ কিংবা নিজ দেশের খেলোয়াড়দেরকে যেন কটূক্তি না করি। প্রতিটি খেলোয়াড়ই চান দেশের বিজয়, সে তার সর্বোচ্চ শ্রমই দিয়ে থাকেন। তাই শুধু শুধু সমালোচনা না করে আমাদের খেলোয়াড়দের পাশে থাকতে হবে। তবেই সাফল্য।
বাংলাদেশের ক্রিকেট আকাশে উঠুক নতুন সূর্য। প্রত্যাশা রইল।