দুই দিনে ১২১০টি, তারপর সারাদেশ জুড়ে

April 12, 2020

বৃত্তের ভেতরে দাঁড়িয়ে মানুষ দোকান থেকে কেনাকাটা করলে ভাইরাস সংক্রমণ অনেকটাই হ্রাস পাবে। দুই দিনে তাই আমরা ৫টি উপজেলায় ৮টি বাজার এবং অসংখ্য অলিগলিতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার দোকানের মধ্যে ২২৯টি ফার্মেসি ও ৯৮১টি মুদি দোকানে সামাজিক দূরত্বের বৃত্ত এঁকে ফেললাম।

সারা বিশ্বে যখন কোভিড-১৯ মহামারি দ্রুতগতিতে ছড়িয়ে পড়ছে, তখন মানুষের মধ্যে সচেতনতা ছড়িয়ে দেওয়ার কাজ আমরাও শুরু করলাম। দিনরাত ২৪ ঘণ্টা যেন এই যুদ্ধে থাকতে পারি আমি নিজে সেই প্রতিজ্ঞা করলাম। মাইকিং, লিফলেট বিতরণ থেকে শুরু করে সব কাজে যেন সাহায্য করতে পারি, সেজন্য বাসা ছেড়ে বিএলসি (ব্র্যাক লার্নিং সেন্টার)-তে এসে থাকবার সিদ্ধান্ত নিলাম। মনে মনে কেবল ভাবছিলাম, অফিসের নির্দেশনা মেনে আরও কীভাবে আমরা মানুষকে সচেতন করতে পারি।

আমি একজন ব্র্যাককর্মী। মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির প্রগতি কুমিল্লা-৫ রিজিওনের রিজিওনাল ম্যানেজার হিসেবে কর্মরত আছি। আমি এবং আমার প্রতিষ্ঠানের নিবেদিতপ্রাণ কর্মীবাহিনীর অনেকেই করোনাভাইরাস মহামারি প্রতিরোধে কাজ করে যাচ্ছি অবিরাম।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সামাজিক দূরত্ব বিষয়টি আমার নজরে এলো। কীভাবে এই ভাইরাস কমিউনিটিতে ছড়ায়, সামাজিক দূরত্ব কীভাবে লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারে সে সম্পর্কে ভালোভাবে জানলাম। জানলাম পাবলিক প্লেস, বাজার, গণপরিবহণে সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা গেলে আমরা লক্ষ মানুষের জীবন বাঁচাতে পারব। দেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করার পর শুধু ফার্মেসি আর মুদি দোকান খোলা রাখার সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো। সামাজিক দূরত্ব ক্যাম্পেইন শুরু করার জন্য আমরা এই দুই ধরনের দোকান এবং কাঁচাবাজারকে টার্গেট করলাম।

২৭শে মার্চ, শুক্রবার। আমরা পুরোদমে কাজে নেমে পড়লাম। লকডাউনে সব দোকান বন্ধ। আমরা রং তুলি জোগাড় করলাম। কাজ দ্রুত করার জন্য পরিত্যক্ত টায়ারকে জীবাণুমুক্ত করে গোল দাগ দেওয়ার কাজে লাগালাম। ডিভিশনাল ম্যানেজার ভাই আগে নিশ্চিত করতে বললেন এই টিমের প্রত্যেক কর্মীর নিরাপত্তা । মুখে মাস্ক, হাতে গ্লাভস এবং দূরত্ব বজায় রেখে কাজ করেছি আমরা।

এলাকাবাসীর কাছ থেকেও পেয়েছি অভূতপূর্ব সাড়া।

এলাকাবাসীদের কেউ ঝাডু দিয়ে দিয়েছেন রং করার আগে, কেউ খাবার নিয়ে এসে বলেছেন: ভাই একটু খেয়ে নিন। সবচেয়ে খুশি হলাম যখন দেখলাম, করোনার সংক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে তারা আমাদের সামাজিক দূরত্বের বৃত্ত ব্যবহার করা শুরু করলেন।

দুই দিনে আমরা ৫টি উপজেলায় ৮টি বাজার এবং অসংখ্য অলিগলিতে প্রায় সাড়ে ৪ হাজার দোকানের মধ্যে ২২৯টি ফার্মেসি ও ৯৮১টি মুদি দোকানে সামাজিক দূরত্বের বৃত্ত এঁকে ফেললাম।

এই বৃত্তের ভেতরে দাঁড়িয়ে মানুষ দোকান থেকে কেনাকাটা করলে ভাইরাস সংক্রমণ অনেকটাই হ্রাস পাবে। এছাড়াও আমরা কর্মস্থলের ২৯০ জন ব্র্যাককর্মীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করলাম। আমাদের কাজকে মডেল হিসেবে ধরে সারাদেশে এই কার্যক্রম শুরু হলো।

আমার বাবা-মা থাকেন নরসিংদী, আর আমার কাজের জায়গা কুমিল্লা। আমার স্ত্রীকেও বাড়ি পাঠিয়ে দিয়েছি। ফোনে যখনই তাদের কারও সাথে কথা হয়, দূরে থেকেও বারবার বলি বাড়ির বাইরে বের না হতে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে। তাদের মনে করিয়ে দিই, সচেতনতাই পারে এই দুর্যোগের সময় আমাদের নিরাপদ রাখতে।

মানুষের পাশে থাকার সদিচ্ছা আমার মনে গেঁথে গিয়েছিল সেই ছোটোবেলাতেই। হিউম্যানিটেরিয়ান ওয়ার্ক, রেস্কিউ অপারেশন ছাড়াও অংশগ্রহণ করেছি জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক পর্যায়ের ক্যাম্পে। এরপর যখন Young Professional হিসেবে ব্র্যাকে যোগদান করি, ফিল্ডে ফিল্ডে ঘুরে বেড়াই, তখন এই বোধটা আরও পাকাপোক্ত হতে থাকে। করোনা মহামারি প্রতিরোধ কাজের শুরুতে আমার বারবার মনে পড়ছিল শ্রদ্ধেয় আবেদ ভাইয়ের কথা। তাঁর জীবনের আদর্শ মেনে আমি কাজ করে যেতে থাকলাম।

দূর্যোগ মানুষের মধ্যে এক অটুট, নিবিড় বন্ধনের জন্ম দেয়। দায়িত্ববোধের কথা প্রতিনিয়ত মনে করিয়ে দেয়। মানুষের প্রতি সেবামূলক মনোভাবকে আরও গভীর করে। করোনার এই দুর্দিনে আমাদের দলের সবার একে অপরের প্রতি মমত্ববোধ দেখে এটাই আমার উপলব্ধি।

আমার কাছে করোনা প্রতিরোধের এই যুদ্ধে অংশ নেওয়া শুধুমাত্র চাকরি নয়। মানবসেবা আমার ব্রত। মানুষের জন্য কাজ করে যাওয়ার এই মূল্যবোধকে আমি এবং আমার প্রত্যেক সহযোদ্ধা আমাদের অন্তরে লালন করি।

 

অনুলিখন- সুহৃদ স্বাগত
সম্পাদনা- তাজনিন সুলতানা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments