কর্মসূচি থেকে তারা শিখেছেন একটি সম্পদকে ব্যবহার করে আরও কয়েক প্রকার সম্পদ করা, সঞ্চয় জমিয়ে তা ব্যবসায় খাটানোর খুঁটিনাটি। শিখেছেন লাভ-ক্ষতির হিসাব; পেয়েছেন জীবন ও জীবিকা বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ। তারা সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানান প্রয়োজনীয় বিষয়ে সচেতন হয়েছেন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবা কীভাবে গ্রহণ করতে হয় সে বিষয়ে হাতেকলমে নিয়েছেন প্রশিক্ষণ।
প্রত্যন্ত গ্রামের দুজন নারী কেমন করে করোনাকাল পার করলেন সেই গল্পটি জানাতে চাই।
প্রথমজন রংপুর জেলার আমরুলবাড়ি গ্রামের সিন্ধুবালা।
কোভিড-১৯ এর শুরু থেকে তিনি এবং তার পরিবারের সদস্যরা স্বাস্থবিধির সব নিয়ম মেনে চলেছেন। পাশাপাশি আশেপাশের সকলে যেন মাস্ক ব্যবহার করেন, কিছুক্ষণ পরপর সাবান-পানি দিয়ে হাত ধোন এবং ভিড় এড়িয়ে চলেন সেজন্যও সচেতনতামূলক কাজ করেছেন। এমনকি যারা খাবারের অভাবে ছিল তিনি তাদেরও সাধ্যমতো সাহায্য করেছেন।
মহামারি শুরুর পর সরকার সাধারণ ছুটি ঘোষণা করলে তিনি বুঝতে পারেন আগামী দিনগুলো হয়তো কঠিন হবে। তিনি ধারণা করতে পারছিলেন আয়রোজগারে টান পরতে পারে। এ কারণে শুরুর দিকেই পাইকারদের কাছে নিজের নার্সারির অনেক চারা গাছ বিক্রি করে দেন। কারণ পরে হয়তো ক্রেতা পাওয়া যাবে না। সাধারণ ছুটি চলমান থাকলে বাজারে নিত্যপ্রয়োজনীয় খাদ্যদ্রব্যের দাম অনেক বেড়ে যেতে পারে এই চিন্তা থেকে বাড়িতে সবজি চাষ আর হাঁস পালন শুরু করলেন।
সিন্ধুবালা নিজের বিচক্ষণতা এবং দূরদৃষ্টি দিয়ে পরিস্থিতি সামলাতে চেষ্টা করেছেন। এর মাধ্যমে একদিকে পরিবারের সবার পুষ্টি নিশ্চিত করেছেন, অন্যদিকে অর্থ উপার্জনও করেছেন।
দ্বিতীয় যার কথা বলব তিনি হলেন নঁওগার বাদলগাছি উপজেলার বেলি রানী।
মানুষের মঙ্গল চান। তাই কাজ করছেন একজন সমাজকর্মী হিসেবে। সুবিধা বঞ্চিত, অতিদরিদ্র আদিবাসী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়ন ও নারীর ক্ষমতায়নে কাজ করছেন।
কোভিড-১৯ মহামরি শুরুর পর তার নেতৃত্বে যেন নতুন চ্যালেঞ্জ যুক্ত হলো। বেলি রানী বাড়ি বাড়ি গিয়ে নিয়ম মেনে হাত ধোয়া, মাস্ক পড়া, জনসমাগম এড়িয়ে চলা ইত্যাদি বিষয়ে মানুষকে সচেতন করেছেন। লিফলেট বিতরণ, দৃশ্যমান স্থানে ষ্টিকার লাগানোসহ অন্যান্য সচেতনতামূলক কাজে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছেন। কেউ অসুস্থ হলে স্বাস্থ্য বিষয়ক হটলাইন নম্বরের ব্যবহার সম্পর্কে তিনি তাকে অবগত করেন এবং সেই ব্যক্তি ও তাঁর পরিবার যেন হটলাইনটি ব্যবহার করেন তাও নিশ্চিত করেছেন।
করোনার কারণে গ্রামের অনেক পরিবার কাজকর্ম হারিয়ে খাদ্যসংকটে ভুগছিলেন এবং পর্যাপ্ত উপকরণের অভাবে স্বাস্থ্য সুরক্ষার নিয়মাবলি পালন করতে পারছিলেন না। সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন সংস্থা এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করে তাদের জন্য খাদ্যসামগ্রী, স্বাস্থ্য সুরক্ষা উপকরণ এবং নগদ অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করেছেন।
বেলি রানীর আরও একটি যোগ্যতা আছে। তিনি একজন প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত মনোবন্ধু। তার প্রাথমিক সাইকোলোজিক্যাল টেকনিক এবং সাইকোসোশ্যাল ফার্স্ট এইডের ওপর প্রশিক্ষণ রয়েছে। কোভিড-১৯ এর কারণে মানসিকভাবে বিপর্যস্ত স্থানীয় দরিদ্র মানুষদের মনোবল বৃদ্ধি করতে তিনি মনোসামাজিক সহায়তা কাউন্সেলিং প্রদান করেছেন।
এখন প্রশ্ন হলো, সিন্ধুবালা বা বেলি রানী কি কোনো সম্ভ্রান্ত বা ধনবান পরিবারের সদস্য? তারা কি শিক্ষিত এবং পারিবারিকভাবেই কাজের দক্ষতা ও নেতৃত্বের গুণ অর্জন করেছেন? এই প্রত্যেকটির প্রশ্নেরই উত্তর হলো ‘না’। সিন্ধুবালা এবং বেলি রানী দুজনই অত্যন্ত দরিদ্র পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছেন। দুজনই বাল্যবিয়ের শিকার। পড়ালেখা করার সুযোগ তারা পাননি। তাদের এই অবস্থান থেকে ক্ষমতায়িত নারীতে পাল্টে দিতে যে সংস্থাটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে তার নাম ব্র্যাক।
জীবনে বাল্যবিবাহ, পারিবারিক নির্যাতন এবং প্রবল অর্থকষ্টের শিকার সিন্ধুবালা। ২০১২ সালে ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন কর্মসূচির সদস্য হন।
সিন্ধুবালার জীবনে পরিবর্তনের সূচনা হয়। কর্মসূচি থেকে পাওয়া মুরগি এবং গরু পালা থেকে শুরু, এখন তার একটি নার্সারিও আছে। সেইসাথে তিনি করেন দর্জির কাজ। গাছের চারা বিক্রি করেও আয় হয়। গবাদি পশু পালনের টাকা দিয়ে স্বামীকে ভ্যান কিনে দিয়েছিলেন তিনি নিজেই।
কর্মসূচি থেকে তিনি শিখেছেন সম্পদকে ব্যবহার করে আরও কয়েক প্রকার সম্পদ করার, সঞ্চয় জমিয়ে তা ব্যবসায় খাটানোর খুঁটিনাটি। শিখেছেন লাভ-ক্ষতির হিসাব; পেয়েছেন জীবন ও জীবিকা বিষয়ে প্রয়োজনীয় পরামর্শ। কর্মসূচির কর্মীরা তাঁকে সামাজিক ও অর্থনৈতিক নানান প্রয়োজনীয় বিষয়ে সচেতন করেছেন। বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি সেবা কীভাবে গ্রহণ করতে হয় সে বিষয়ে হাতেকলমে শিখিয়েছেন।
গ্রামের সচ্ছল জনগোষ্ঠীর আস্থা অর্জনেও তারা সহযোগিতা করেছেন। নিজ প্রচেষ্টায় সিন্ধুবালা আত্মবিশ্বাসী এবং দক্ষ হয়ে উঠেছেন। নিরক্ষর সিন্ধুবালার এক মেয়ে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং আরেক মেয়ে রংপুরে বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছে।
অন্যদিকে বাল্যবিয়ের শিকার বেলি রানী ছিলেন গৃহবধু। তার স্বামী দিনমজুরি করে যে অর্থ উপার্জন করতেন তা দিয়ে সংসার চলতো না। গ্রামের যে দরিদ্র গৃহবধু নিজের বাড়ির বাইরে যাওয়ার সাহস পেতেন না সেই বেলি রানীর পাশে দাঁড়িয়েছিল ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচি। পল্লীসমাজে সাধারণ সদস্য হিসেবে যোগদানের পর বেলি রানী নিয়মিত বিভিন্ন সভায় যোগদান, কমিটির অন্যান্য নারী সদস্যদের সঙ্গে ন্যায্য দাবিদাওয়া নিয়ে সরকারি-বেসরকারি নানা প্রতিষ্ঠানের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করা আর দক্ষতা উন্নয়ন প্রশিক্ষণ প্রাপ্তির মাধ্যমে দক্ষ সমাজ সেবক হয়ে উঠেছেন।
সকলের মন জয় করে অল্প সময়ের মধ্যে পল্লীসমাজের সভাপ্রধানের পদ অর্জন করেছেন। নিজ এলাকায় কোথাও কোনো ধরনের সমস্যা বা অসঙ্গতি দেখা দিলে এখন সেখানে পৌঁছে যান বেলী রানী। পল্লীসমাজের উদ্যোগে নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা, বাল্যবিয়ে, তালাক, ধর্ষণ, যৌন হয়রানি প্রতিরোধসহ শারীরিক নির্যাতনের শিকার ভুক্তভোগীকে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসতে সহায়তা প্রদান ও পুনর্বাসনের ব্যবস্থাও তিনি করে থাকেন।
বেলি রানী সমাজসেবায় তার অনন্য অবদানের জন্য ২০২০ সালে জয়িতা সম্মাননা পেয়েছেন।
সিন্ধুবালা আর বেলি রানীর কোভিড-১৯ মোকাবিলার ঘটনা থেকে এটাই প্রমাণিত, নারীরা শক্ত হাতে হাল ধরতে জানেন। আমাদের দেশের গ্রামে গ্রামে ছড়িয়ে আছেন এই দুইজনের মতো আরও অনেক নারী। তারা নিজ পরিবারের অর্থনীতির চাকা চলমান রাখা থেকে শুরু করে দরিদ্র অসহায় মানুষের সামগ্রিক উন্নয়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। গ্রামবাসী তাদের সম্মান করে, তাদের কথা ও নেতৃত্বকে মান্য করে।
একটা সময় ছিল যখন তারা নিজেরাও নিজেদের দুর্বল, অসহায় বলেই মনে করতেন। অন্য আরও অসংখ্য দরিদ্র নারীর মতো তারাও ভাবতেন দারিদ্র্য তাদের ভাগ্যে লেখা ছিল। তাদের মতো তাদের সন্তানরাও ভবিষ্যতে না খেয়েই জীবন পার করবে। অথচ আজ বাস্তবতা ভিন্ন।
সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা
Inspiring