থেমে থাকবে না শিক্ষা

June 11, 2020

কথা হয় লকডাউন নিয়ে, তাদের মনে আত্মবিশ্বাস এবং শক্তি জোগাতে বোঝানো হয় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্র্যাক যথাযথভাবে তার শিক্ষা কারিকুলাম এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতেও নতুনত্ব আনতে কাজ করছে। ব্র্যাকের কাছে তার প্রত্যেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তা এই মুহূর্তে পাচ্ছে সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার।

তারা ভবিষ্যতে সমাজের প্রতিনিধিত্ব করবে, তাদের খুলে দেওয়া জানালা দিয়ে পরিবারে প্রবেশ করবে পরিবর্তনের আলো! এই ‘তারা’ আমাদের দেশের মেধাবী সন্তানেরা, যাদের সাথে ব্র্যাক আছে গত ৪৫ বছর ধরে। এখন এক অনিশ্চিত সময়, এসময় তাদের প্রতি এই সংস্থার দায়িত্ব বেড়ে গেছে বহুগুণ।

দুঃস্বপ্নের মতোই শোনায়, কিন্তু সারাবিশ্বে আজ প্রায় কেউই স্কুলে যায় না। ক্লাসরুমগুলোতে ঝুলছে তালা, বাজে না আর ছুটির ঘণ্টা।  করোনাভাইরাসের কারণে পৃথিবীর সব দেশ তাদের স্কুল বন্ধ ঘোষণা করতে বাধ্য হয়েছে; অর্থাৎ, বিশ্বব্যাপী প্রায় ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থীর সাথে ক্লাসরুমের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন।

বাংলাদেশে গত মার্চ মাসের ১৬ তারিখ সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ ঘোষণা করা হয়েছে। থেমে গেছে অনেক শিক্ষার্থীর পড়ালেখা। তাদের সংখ্যাটা কিন্তু নেহায়েত কম নয়-প্রায় ৩০ শতাংশ।

লকডাউনের কারণে এমনিতেই রোজগার বন্ধ হয়ে গেছে লাখো পরিবারের। অগণিত মানুষের ঘরে খাবার কেনার টাকা পর্যন্ত নেই। এই অনিশ্চিত এবং অনাকাঙ্ক্ষিত পরিস্থিতিতে আমাদের সন্তানেরা সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে।

ব্র্যাক লড়াই করে আসছে মানুষের শিক্ষার অধিকার নিশ্চিত করতে, এই দুর্যোগেও সেই লড়াই থেমে নেই। শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে নিতে ব্র্যাক বর্তমানে যে কাজগুলো করছে:

–  প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষাদান চালিয়ে যেতে সরকারকে সহযোগিতা প্রদান

–  বেসিক ফোনের মাধ্যমে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের নিয়মিত পাঠদান শুরু করার পরীক্ষামূলক কার্যক্রম

–  কোভিড-১৯ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন এবং শিক্ষার্থীদের কাছে নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য পৌঁছে দিতে নানা প্রচেষ্টা

প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক স্তরের সকল শিক্ষার্থীর জন্য শিক্ষাদান চালিয়ে যেতে সরকারকে সহযোগিতা প্রদান

সরকারের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা অধিদপ্তর এবং প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সাথে একযোগে নিবিড়ভাবে কাজ করছে ব্র্যাক শিক্ষা কর্মসূচি। এছাড়াও, অন্যান্য বেশ কিছু সংস্থার পাশাপাশি ব্র্যাক কাজ করছে নতুন নতুন বিষয় পাঠ্যসূচিতে অন্তর্ভুক্তিকরণে। বিকল্প পদ্ধতিতে ক্লাস নেবার জন্য দেশের শিক্ষকদের প্রস্তুতি ফলপ্রসূ করতে তাদের সঙ্গে আছেন ব্র্যাকের প্রশিক্ষকেরা।

প্রতিটি পদক্ষেপের কার্যকারিতা এবং সীমাবদ্ধতাগুলো ভালোভাবে বুঝতে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে এই কার্যক্রমগুলো পর্যবেক্ষণ করছে ব্র্যাক। পরবর্তীতে  জাতীয় পর্যায়ে ব্র্যাকের কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং বাস্তবায়নে এই বিষয়গুলো সাহায্য করবে।

বেসিক ফোনের মাধ্যমে ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষার্থীদের পাঠদান শুরু করার পরীক্ষামূলক কার্যক্রম

পরীক্ষামূলকভাবে, বাংলাদেশের ৪টি এলাকায় ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষকরা তাদের শিক্ষার্থীদের বাবা-মায়ের মোবাইলে গ্রুপ কলের মাধ্যমে ৩-৪ জনের গ্রুপ করে ক্লাস নিচ্ছেন।

এই ভার্চুয়াল ক্লাসগুলো নেওয়া হচ্ছে সপ্তাহে দুই দিন। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে ২০৪টি ব্র্যাক স্কুলের প্রায় ৩,৭০০ শিক্ষার্থীর মাঝে এই কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছিল। এই মুহূর্তে (জুনের মাঝামাঝি) ২,৩৫৬টি স্কুলে প্রায় ৭০,০০০ শিক্ষার্থীর কাছে পৌঁছে গেছে এই পদ্ধতি। এখনও পর্যন্ত শুধুমাত্র ৫ম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এই ক্লাসে অংশ নিচ্ছে।

ভার্চুয়াল ক্লাস পদ্ধতিতে প্রথম তিনটি ক্লাসে শিক্ষকরা তাদের নিজ নিজ শিক্ষার্থীদের প্রত্যেকের মনোসামাজিক অবস্থার দিকে- পড়াশোনার জন্য তাদের মনকে ভালো এবং প্রস্তুত করতে মনোযোগ দেবেন। ৪র্থ এবং ৫ম দিন থেকে শুরু হবে স্কুল বন্ধের আগে কতটুকু পর্যন্ত পড়ানো হয়েছিল সেগুলো নিয়েই আলোচনা করা। প্রথম সপ্তাহ শেষে শুরু হবে নিয়মিত সিলেবাস অনুযায়ী পড়ালেখা।

প্রতিবারই ৬ষ্ঠ ক্লাসটি হবে একটি বিশেষ ক্লাস, যে ক্লাসের সময় শিক্ষক নিজেই নির্ধারণ করবেন। এটি মূলত প্রতিবন্ধী শিক্ষার্থীদের জন্য, যাদের শুনতে সমস্যা হয়। পাশাপাশি এই ক্লাসে যারা আগের কোনো ক্লাসে অংশ নিতে পারেনি বা যাদের কোনো বিষয়ে বিশেষ যত্ন প্রয়োজন তারাও অংশ নিতে পারবে।

কুমিল্লার ব্র্যাক একাডেমিতে চলছে একটু ভিন্ন ব্যবস্থা। সেখানে মোবাইলের মাধ্যমে নার্সারি থেকে ২য় শ্রেণিতে পড়া খুদে শিক্ষার্থীদের মধ্যে চলছে পাঠদান!

৯৪জন শিক্ষার্থী এই ক্লাসে অংশ নিচ্ছে। এখানে অংক, বাংলা, ইংরেজি পাঠসহ শিক্ষার্থীরা ছবি আঁকা এবং গল্প বলার মতো সহশিক্ষা কার্যক্রমেরও অংশ হচ্ছেন।

কোভিড-১৯ বিষয়ে সচেতনতা বৃদ্ধি, নিরাপদ সামাজিক দূরত্ব, লকডাউন এবং শিক্ষার্থীদের কাছে নিরাপত্তা বিষয়ক তথ্য পৌঁছে দিতে নানা প্রচেষ্টা

ব্র্যাক স্কুলের শিক্ষকগণ প্রতিটি ক্লাসই শুরু করেন করোনাভাইরাসের দিনে শিক্ষার্থীরা নিয়ম মেনে চলছে কিনা, তাদের বাবা-মা কেমন আছেন ইত্যাদি নানা ধরনের জরুরি খোঁজ-খবর নিয়ে।

“পাঁচ মিনিটের জন্য সবার চোখ বন্ধ, চিন্তা করো আমরা পাখির মতো উড়ছি আকাশে!”

শারমিন আক্তার চট্টগ্রামে ব্র্যাকের একটি প্রাইমারি স্কুলে পড়ান। সময়ের সাথে তাল মেলাতে তিনিও মোবাইলের মাধ্যমে তার ছাত্রছাত্রীদের ক্লাস নিচ্ছেন। সবার মনের সুস্থতার দিকে তিনি বেশি নজর দিয়ে থাকেন, তাই ক্লাসের শুরুতেই তিনি মনোসামাজিক কাউন্সেলিং-এর মাধ্যমে তাদের মনের উদ্বেগ বা দুশ্চিন্তা কমানোর চেষ্টা করেন, মহামারির এই সময়ে যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

লকডাউনের সময় শারমিনের ক্লাসের অনেক শিক্ষার্থী, বিশেষ করে ছেলেরা তাদের পরিবারকে সাহায্য করতে কৃষিকাজে যোগ দেয়, মেয়েরা ঘরে থেকেই যোগাযোগের মাধ্যমে বাইরের কাজ, ঘরের কাজ করতে শুরু করে। মোবাইলে ক্লাস করানোর মাধ্যমে শারমিন তাদের সবাইকে আবার পড়ালেখার রুটিনে ফিরিয়ে নিয়ে এসেছেন!

প্রতিটি ক্লাসের শেষেই একটি অলিখিত সচেতনতামূলক সেশন থাকে! নিরাপদ এবং সুস্থ থাকার জন্য শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার নিয়মকানুন মেনে চলা এবং করোনাভাইরাস নিয়ে নানারকম সতর্কতামূলক আলাপ করা হয়। প্রত্যেক শিক্ষক নিজেদের মতো করে করোনা সংক্রমণ এবং সংক্রমণ এড়ানোর উপায়গুলো নিয়ে বলেন, আরও বলেন বারবার সঠিকভাবে হাত ধোয়ার কথা।

কথা হয় লকডাউন নিয়ে, তাদের মনে আত্মবিশ্বাস এবং শক্তি জোগাতে বোঝানো হয় সামাজিক দূরত্ব মেনে চলার কথা। কোভিড-১৯ মোকাবিলায় ব্র্যাক যথাযথভাবে তার শিক্ষা কারিকুলাম এবং শিক্ষাদান পদ্ধতিতেও নতুনত্ব আনতে কাজ করছে। ব্র্যাকের কাছে তার প্রত্যেক শিক্ষার্থী, শিক্ষক এবং তাদের পরিবারের নিরাপত্তা এই মুহূর্তে পাচ্ছে সবচেয়ে  বেশি অগ্রাধিকার।

ব্র্যাকের সোশ্যাল ইনোভেশন ল্যাব, ব্র্যাক ইন্সটিটিউট অফ এডুকেশনাল ডেভেলপমেন্ট এবং জাতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের সাথে ব্র্যাকের শিক্ষা কর্মসূচি সমন্বয় সাধন করে কাজ করছে। নতুন নতুন উদ্ভাবন এবং এর কার্যকর বাস্তবানের উদ্দেশ্যে ব্র্যাক দৃঢপ্রতিজ্ঞ।

আমাদের অভিজ্ঞতা বলছে, এবার অনেক কিছু নতুন করে ঢেলে সাজাবার সময় এসেছে। এখন থেকে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্ত হবে নতুন কিছু, করোনা ওলটপালট করে দিয়েছে অনেক কিছু। মহামারি মোকাবিলায় এবং পরবর্তী সময়ে আজকের সচেতন শিশু হতে পারে আগামী দিনের নিরাপত্তার বাহক।

 

ইংরেজি http://blog.brac.net/how-bangladesh-is-continuing-education-in-a-pandemic/ লেখাটি অবলম্বনে অনূদিত।

5 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Subrata Day
Subrata Day
3 years ago

করোনাকালীন সময়ে ব্র্যাকের এমন একটি উদ্দ্যোগ প্রকৃতপক্ষে প্রশংসার দাবীদার। ব্র্যাকের এমন দূর্যোগকালীন কার্যক্রম আমরা এর আগেও দেখেছি। তারা বিভিন্ন সময় বিভিন্ন প্রজেক্টের মাধ্যমে এমন কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে।