রেডিও পল্লীকন্ঠ ব্র্যাকের একমাত্র কমিউনিটি রেডিও। এটি দেশের মৌলভিবাজার জেলায় পরিচালিত হচ্ছে। প্রায় ৯৫ শতাংশ সময় এখানে সিলেটি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। অন্য যে কোনো আঞ্চলকি ভাষার মতো সলিটেি ভাষারও রয়েছে স্বতন্ত্র্য ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। শুনলে মনে হবে এ ভাষা যেন কত আপন, কত কাছের।
গাড়িতে এফএম রেডিও বাজছিলো। খবর, গান, আলোচনা সবই চলছে একের পর এক। আমরা চলছিলাম আঁকাবাঁকা পাহাড়ি রাস্তা ধরে। মৌলভিবাজার সদরের কাছাকাছি এসে তরুণ যাত্রাসঙ্গীরা রেডিও-এর ভলিউম আরও বাড়িয়ে দিল। আওয়াজের সাথে সাথে যেন রেডিও-এর ভাষাও পাল্টে গেল!
এ আবার কোন ধরনের বাংলা ভাষা! আসল ব্যাপারটি হলো, ভাষাটি যে কারও কাছেই বেশ দুর্বোধ্য মনে হবে, যদি না তিনি সিলেটি হয়ে থাকেন । এখানে বলে রাখা ভালো, বাংলা ভাষার একটি উপভাষা এই সিলেটি ভাষা যার উৎপত্তি সেই ১৩শ শতাব্দিতে। কিন্তু পৃথিবীর অধিকাংশ উপভাষার মতো এই ভাষার ব্যবহারও দিন দিন কমতির দিকে- বিশেষ করে তরুণদের মাঝে।
রেডিওতে ভেসে আসছে সিলেটি উপভাষায় এক সাবলীল কন্ঠস্বর।
এখন হুনাইরাম রবীন্দ্রসংগীত-মাঝে মাঝে তব….
(এখন আপনারা শুনবেন রবীন্দ্রসংগীত- মাঝে মাঝে তব…..)
আমরা আবার আইরাম, অউনু এসএমএস কইরুন ০১৭৮০২০১৩১৩
(একটু পরেই ফিরে আসছি, এসএমএস করুন ০১৭৮০২০১৩১৩ নম্বরে)
রেডিও পল্লীকন্ঠ ব্র্যাকের একমাত্র কমিউনিটি রেডিও। এটি দেশের মৌলভিবাজার জেলায় পরিচালিত হচ্ছে। প্রায় ৯৫ শতাংশ সময় এখানে সিলেটি ভাষায় অনুষ্ঠান প্রচারিত হয়। অন্য যে কোনো আঞ্চলকি ভাষার মতো সলিটেি ভাষারও রয়েছে স্বতন্ত্র্য ও স্বকীয় বৈশিষ্ট্য। শুনলে মনে হবে এ ভাষা যেন কত আপন, কত কাছের।
এখানেই লুকিয়ে আছে কমিউনিটি রেডিও-র শক্তি, মনের ভাষাকে এটি বৈধতা দেয়, প্রসার ঘটায় এবং সংরক্ষণ করে। রেডিও পল্লীকন্ঠ সিলেটি ভাষাকে শুধু যে বাঁচিয়ে রাখছে তা নয়, পুরো সিলেটি জনগোষ্ঠীকে যেন এটি একই সূতায় বাঁধছে।
মৌলভিবাজারের প্রত্যন্ত অ ল থেকে উঠে আসা এক ঝাক উদ্যমী ও কর্মঠ তরুণ-তরুণী অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে পরিচালনা করছে এই রেডিও। একজন ষ্টেশন ম্যানেজার এবং একজন প্রোগ্রাম প্রডিউসারসহ ৩০ জন অদম্য মেধাবী তরুণ-তরুণী নিজেরাই স্ক্রিপ্ট লিখছে, নিজেরাই সাক্ষাতকার নিচ্ছে, নিজেরাই ভয়েস দিচ্ছে, নিজেরাই সম্পাদনা করছে, নিজেরাই সম্প্রচারের যাবতীয় টেকনিক্যাল বিষয়াদি দেখছে। দৈনিক ১২ ঘন্টা ব্যাপী অনুষ্ঠান সম্প্রচারিত হচ্ছে।
রেডিও পল্লীকন্ঠ তরুণদের কন্ঠস্বর, কমিউনিটির পিছিয়ে পড়া জনগণের জন্যই তারা কথা বলে।
বিভিন্ন বিষয় নিয়ে রেডিও পল্লীকন্ঠতে আলাপ-আলোচনা প্রচারিত হয়। বিভিন্ন বিশেষজ্ঞের দেওয়া স্বাস্থ্য-বিষয়ক, কৃষি-বিষয়ক, আইন ও অধিকার বিষয়ক পরামর্শ এবং স্থানীয় কোন ভালো খবরও এই রেডিওতে প্রচারিত হয়।
অনেক সময় শ্রোতারা নিজেরাই ঠিক করেন কি বিষয়ে তারা শুনতে চান। সে অনুযায়ীই অনুষ্ঠান সঞ্চালকগণ কথা বলেন, বিভিন্ন প্রশ্ন করেন, মতামত দেন এবং শ্রোতাদের কোনো সমস্যার সমাধান খোঁজেন। শ্রোতারা অনুষ্ঠান চলাকালীন ফোন করতে পারেন, সামাজিক মাধ্যমে কমেন্ট করেন এবং কেউ কেউ হয়তো একত্র হয়ে কখনও নিজেদের প্রশ্ন ও মতামত জানিয়ে এসএমএস করেন।
কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠান ‘কৃষিকথা’য় একজন কৃষি বিশেষজ্ঞ থাকেন যিনি সরাসরি সরাসরি সম্প্রচারকালীন শ্রোতাদের বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দিয়ে থাকেন। স্বাস্থ্যবিষয়ক অনুষ্ঠান ‘সুস্বাস্থ্য’-এর মাধ্যমে শ্রোতা ও স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞের মধ্যে সরাসরি কথা হয়। কোন কোন অনুষ্ঠানে শ্রোতারা নিজ নিজ এলাকার বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেন। এর জন্য নির্দিষ্ট সময়ও বরাদ্দ থাকে।
৬৫ বছরের এক বৃদ্ধ নারী একবার জানাচ্ছিলেন কিভাবে ইচ্ছের বিরুদ্ধে, কবুল না বলা সত্ত্বেও, তাঁকে বিয়ে দেওয়া হয়েছিল এবং এর পরিণতিতে তাঁকে কত কষ্ট ও যন্ত্রণা পোহাতে হয়। এত বছর পর নিজের কষ্টের কথা বলতে পেরে, বাল্যবিবাহের ক্ষতিকর দিকগুলো সম্পর্কে বলতে পেরে বৃদ্ধার নিজেকে অনেক হালকা মনে হচ্ছিল।
‘আইন ও জীবন’ নামের অনুষ্ঠান করতে গিয়ে সঞ্চালক রোজিনা বেগম তার অভিজ্ঞতার কথা বলেন। একজন শ্রোতা বলেছিলেন কলেজে যাওয়া-আসার পথে তিনি রোজ ইভ-টিজিংয়ের শিকার হচ্ছিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না ইভ-টিজিং কী এবং এর প্রতিরোধে তার করণীয় কী। উল্টো তিনি এর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে করতেন। ‘আইন ও জীবন’ অনুষ্ঠান শুনে ছাত্রী সাহস সঞ্চার করেন এবং এর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ান। এতে সে ইভ-টিজিং থেকে মুক্তি পায়। এবং অন্য কোন মেয়েকেও এর শিকার হতে দেখলে তার সাহায্যে এগিয়ে যায়।
মনু নদীর পাড়ে ব্যস্ত বাজার অতিক্রম করতেই একটি সেলুন চোখে পড়ে। পেশায় নাপিত এবং সখের কবি সুমন সেখানে সারাদিনই ৯৯.২ এফএম চালিয়ে রাখেন। তিনি আবার রেডিও পল্লীকন্ঠের লিসেনারস ক্লাবেরও সদস্য। ক্লাবের সদস্যরা মাসে একবার তার দোকানে বসে এলাকার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করেন এবং কীভাবে আরও কার্যকর অনুষ্ঠান তৈরি করা যায় সে ব্যাপারে পল্লীকন্ঠকে পরামর্শ প্রদান করেন। এলাকায় কোনো নারী বখাটে কর্তৃক হয়রানির শিকার হলে সুমন তার প্রতিবাদ করেন, প্রতিহত করেন। এক ডাক্তারের অনৈতিক কর্মকান্ডের বিরুদ্ধে এই ক্লাবের সকল সদস্য ঐক্যবদ্ধভাবে প্রতিবাদ করেছিল।
এই কমিউনিটি রেডিও স্টেশন ইতিমধ্যে জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে পরিচিতিও লাভ করতে শুরু করেছে!
রেডিও পল্লীকন্ঠের সুতপা রাণী পাল বর্তমানে অভিজ্ঞতা বিনিময় কর্মসূচির আওতায় নেপালে রয়েছেন, অন্যদিকে নেপালি কমিউনিটি রেডিও ‘রেডিও রুদ্রাক্ষ-র’ একজন প্রতিনিধি রেডিও পল্লীকন্ঠে কাজ করছেন। আমেরিকান সেন্টারের সহায়তায় ‘আও ইংলিশ হিকি’ (আসুন, ইংরেজি শিখি) নামক একটি অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে গিয়ে মিঠু নিজে তার ইংরেজি বলার দক্ষতা অর্জন করে। এই অনুষ্ঠানেরই সুবাদে ২০১৭ সালে একটি কর্মশালায় অংশ্রগহণ করতে মিঠু পাঁচ সপ্তাহের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ভ্রমন করে। সেখানে মিঠু তার জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধির সুযোগ পায়। তার ভাল লাগে যখন একজন আগুনে পুড়ে যাওয়া রোগীর সাহায্যার্থে একটি ক্যাম্পইনের মাধ্যমে শ্রোতাদরে কাছ থেকে ৭০,০০০ টাকা উঠেছিল।
দেশের কমিউনিটি রেডিওগুলোর মধ্যে রেডিও পল্লীকন্ঠই প্রথম জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পুরস্কার অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। গত ৭ বছরে ১৭টি পুরষ্কার অর্জন করেছে যার মধ্যে শুধু ২০১৭ সালেই তারা একটি আন্তর্জাতিক ও তিনটি জাতীয় পুরস্কার অর্জন করার কৃতিত্ব অর্জন করেছে।
বিশ্বের মোট জনসংখ্যার প্রায় ৭০ ভাগের কাছেই রেডিও একটি সহজপ্রাপ্য যোগাযোগ মাধ্যম। তথ্য, বিনোদন ও খবরাখবর সংগ্রহের ক্ষেত্রে এটি সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য মাধ্যমগুলোর একটি।
একটি জনগোষ্ঠীর কন্ঠস্বর জাগ্রত করতে রেডিও পল্লীকন্ঠ যে ভূমিকা পালন করছে তা একই সাথে গৌরব এবং প্রশংসার দাবি রাখে। তারুণ্যের শক্তিতে বলীয়ান এক ঝাঁক উদ্দীপ্ত তরুণ-তরুণী এই জাগরণ এবং সোচ্চার কন্ঠস্বর প্রতিষ্ঠায় রাখছে এক দৃষ্টান্তমূলক এবং অগ্রণী ভূমিকা। নিজস্ব গন্ডির মধ্যে দোকানপাট, বাজার, বাড়ি এবং সর্বত্র যেভাবে সকলে ভালবাসা এবং উৎসাহ নিয়ে রেডিও পল্লীকন্ঠ বাজিয়ে থাকেন, তাতে যে খুব শীঘ্রই সিলেটি ভাষা হারিয়ে যাচ্ছে না তা নির্দ্বিধায় বলা যায়।
খুবই ভালো উদ্দ্যোগ।
very good and informative content