ডিগ্রী ছাড়া যে ডাক্তার হাজারো জীবন বাঁচিয়ে যাচ্ছেন

September 15, 2017

সকাল ৬টা। গাজীপুরের কালিয়াকৈর গ্রাম। ‘ব্র্যাক স্বাস্থ্য সেবিকা’ লেখা একটি বোর্ডের পাশে ইতিমধ্যেই অপেক্ষমান নিলুফার ইয়াসমিনের কয়েকজন রোগী। তাদের মধ্যে কেউবা কৃষক, কেউবা দোকান চালান। তাঁরা যার যার কাজে যাবার আগে ‘ডাক্তার আপা’র কাছে এসেছেন, যক্ষার নিয়মিত ওষুধ নেবার জন্য।

নিলুফারকে ১৩ বছর বয়সেই তাঁর বাবা-মা বিয়ে দিয়ে দেন এবং এর কিছুদিনের মধ্যেই তাঁর প্রথম সন্তান জন্ম নেয়। ফলস্বরূপ, তাঁর স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে যায়। কিন্তু তিনি তাঁর স্বাধীনতা হারাতে চাইলেন না, পরিবারের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তিনি কিছুদিন যেতে না যেতেই একটি কাজে যোগ দিলেন। শ্বশুরবাড়ির আত্মীয়দের কাছে সন্তানদের রেখে তিনি মানুষের বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে মনোনিবেশ করলেন।

দ্রুতই নিলুফারের নতুন চাকুরির ব্যাপারে তাঁর পরিবারের দৃষ্টিভঙ্গি বদলে যায়। এক রাতের কথা। এপ্রিল মাস। রাত তখন প্রায় ৩টা। বাইরে প্রবল ঝড়বৃষ্টি। এরই মধ্যে তাঁকে ঘুম থেকে তড়িঘড়ি করে ডেকে তোলা হয়। প্রতিবেশী মাজেদার সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার পথে। তিনি তখনতখনই মাজেদার বাড়ি পৌঁছান, অবস্থা পরীক্ষা করেন, যাতায়াতের বন্দোবস্ত করেন এবং সেই পরিবারের সকলের সাথে নিকটস্থ হাসপাতালে রোগীকে নিয়ে যান।

‘সেই রাতের পর থেকেই আমি আমার কাজটাকে সত্যিকারভাবে ভালবাসতে শুরু করি’ তিনি বলেন, ‘মা এবং সন্তান, দু’জনের জীবনই সেদিন আমি বাঁচাতে পেরেছিলাম’।

সেদিনের পর তাঁর পরিবার বুঝতে পারে নিলুফারের কাজ কতটা গুরুত্বপূর্ণ। তাঁর স্বামীও এরপর থেকে আর কখনই কাজ নিয়ে তাঁকে কোন প্রশ্ন করেননি। পরদিন ঘুম ভাঙ্গলে তিনি তাঁকে এই আশ্বাসও দেন যে আর কখনই নিলুফারকে বাইরে বের হতে হলে বাড়ির কারও অনুমতি নিতে হবে না। অনেক বছর পরের কথা। তাঁর স্বামী তখন কাতার প্রবাসী। সেখান থেকে তিনি নিলুফারের সাথে টেলিফোনে কথা বলছেন। এসময় হঠাৎই এক বৃদ্ধ প্রতিবেশী নিলুফারের কাছে রক্তচাপ পরীক্ষা করাতে আসেন। নিলুফারের স্বামী তাঁকে বলেন আগে রোগীর দিকে যেন তিনি মনোযোগ দেন। তিনি তো পাশে থাকবেনই সবসময়, কাজেই অন্য যেকোন সময় কথা বলা যাবে।

‘আমি যখন ছোট ছিলাম’ নিলুফার বলে চলেন, ‘তখন আমি ডাক্তার হবার স্বপ্ন দেখতাম। কিন্তু নিজের সন্তান হবার পর বুঝলাম এই স্বপ্ন পূরণ হবার নয়। তবে আমি মনে করি এখন যা করছি, কোনদিন ডাক্তার হতে পারলেও এতকিছু আমার পক্ষে করা সম্ভব হতো না। চিকিৎসা সেবা তো আমি দিচ্ছিই, সেই সাথে কতজনের কাছে আজ আমি মা, কতজনের কাছে বন্ধু!’

এখন পর্যন্ত নিলুফার প্রায় ৩০০ জন সন্তান প্রসবে সহায়তা করেছেন। তাঁর কাজের আওতায় আছে প্রায় ৪০০টি পরিবার। এবং এর বাইরেও তিনি নিজের এবং নিজ এলাকার বাইরে হাজারো মানুষের প্রয়োজন মেটানোর চেষ্টা করে থাকেন।

নিলুফারের জন্য যে কেবল তাঁর রোগীরাই অপেক্ষায় থাকেন তা নয়, তাঁর কিন্তু কিছু ছাত্রছাত্রীও আছে। তিনি এখন একজন প্রশিক্ষিত আইনসেবিকা, যিনি প্রতি সপ্তাহে ২০ জনকে পড়ান।

ব্র্যাক এমন এক বিশ্ব নির্মাণে নিবেদিত যা প্রত্যেক ব্যক্তির সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশের সুযোগ নিশ্চিতকরণে বিশ্বাসী। অপরদিকে নিলুফারের মত তাঁরাও আমাদের সহযাত্রী যারা প্রতিদিন এই বিশ্বাস মনে ধারণ করেন যে সবার জন্য বাসযোগ্য একটি সুন্দর পৃথিবী একদিন আমরা নির্মাণ করবই।

আসুন সুন্দরের পথে আসি। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় পরিবারের অংশ হোন।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments