টেকসই উন্নয়নের অন্যতম চ্যালেঞ্জ শিক্ষার মানোন্নয়ন

February 7, 2018

শুধু শ্রেণিকক্ষ নির্মাণ নয়, শিক্ষাসহায়ক পরিবেশও জরুরি: স্যার আবেদ

নতুন বছরের শুরুতে দেশে তৃতীয়বারের মতো সরকার ও উন্নয়ন সহযোগীদের নিয়ে বাংলাদেশ ডেভেলাপমেন্ট ফোরাম (বিডিএফ) অনুষ্ঠিত হয়ে গেল। জানুয়ারির ১৭-১৮ তারিখে আয়োজিত দুদিন ব্যাপী এই অনুষ্ঠানের প্রধান আলোচ্য বিষয় ছিল তিনটি – দেশের উন্নয়ন লক্ষ্য ও তা বাস্তবায়নের বর্তমান পরিস্থিতি, প্রয়োজনীয় অর্থের যোগান এবং সময়ের মধ্যে উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে করণীয়। অনুষ্ঠানে সরকার প্রধান ও শীর্ষ পর্যায়ের ব্যক্তিবর্গ এবং দাতাগোষ্ঠী ও উন্নয়ন সহযোগীদের গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা ও মতামত বাংলাদেশ সরকারের পরিকল্পনা ও কর্মকা- পরিচালনার ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ দিকনির্দেশনা যোগায়। এর আগের দুটো বিডিএফ আয়োজিত হয়েছিল ২০০৯ ও ২০১৫ সালে।

বাংলাদেশ সরকার ও দাতাগোষ্ঠী এবং অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীদের মধ্য থেকে প্রায় ৭০০ প্রতিনিধি ঢাকার হোটেল সোনার গাঁওয়ে অনুষ্ঠিত এই সম্মেলনে যোগ দেন। ‘উন্নয়নের লক্ষ্যে অংশীদারত্ব’ স্লোগান নিয়ে অনুষ্ঠিত তৃতীয় বিডিএফ-এর উদ্বোধনপর্বে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর বক্তৃতায় তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোর টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনে শিল্পোন্নত দেশগুলোকে পর্যাপ্ত অর্থায়নের জন্য আহ্বান জানান।

অনুষ্ঠানের প্রথমদিন ‘সপ্তম পঞ্চম বার্ষিকী পরিকল্পনা ও টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য বাস্তবায়নে চ্যালেঞ্জসমূহ ও তা মোকাবেলার উপায়’ শীর্ষক মূল প্রবন্ধ পর্বে প্যানেল আলোচক হিসাবে বক্তব্য দেন ব্র্যাকের প্রতিষ্ঠাতা-চেয়ারপারসন স্যার ফজলে হাসান আবেদ।

দারিদ্র্য বিমোচন এবং অন্যান্য সামাজিক-অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে বিপুল কর্মকা-ের মাধ্যমে দেশকে এগিয়ে নেওয়ার জন্য সরকারকে অভিনন্দন জানিয়ে স্যার আবেদ বলেন, ‘আমাদের দেশের সকল মানুষ যাতে সম্মান ও আশার সঙ্গে বেঁচে থাকতে পারেন এবং তাঁদের সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারেন সেজন্য আমাদের আরো অনেক কিছু করার রয়েছে। এজন্য বর্তমানে মৌলিক সেবা প্রদানের দিকে নিবদ্ধ আমাদের মনোযোগ সরিয়ে এসব সেবার মান উন্নয়নের প্রতি নিবদ্ধ করতে হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস সরকার, নাগরিক সামাজিক সংগঠন এবং ব্যক্তিমালিকানা খাতের মধ্যে অর্থপূর্ণ ও দীর্ঘস্থায়ী অংশীদারত্বর মধ্য দিয়ে আমাদের দেশের পরবর্তী পর্যায়ের প্রত্যাশিত উন্নয়ন নিশ্চিত করা সম্ভব।’

টেকসই উন্নয়ন নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে তিনি জোর দেন মূলত তিনটি বিষয়ের ওপর: ১. দেশ থেকে চরম দারিদ্র্য দূর করা, ২. সকলের জন্য মানসম্পন্ন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা এবং ৩. শিক্ষার মানোন্নয়ন ঘটানো। চরম দারিদ্র্য নিরসনের ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের চরম দারিদ্র্য নিরসনকে আমাদের সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার দিতে হবে। আমাদের দেশ দারুণ অগ্রগতি অর্জন করেছে একথা যেমন সত্য, একইসঙ্গে সত্য দেশের দুই কোটি মানুষ এখনও চরম দারিদ্র্যক্লিষ্ট ও বঞ্চিত অবস্থায় দিনযাপন করে চলেছেন।’

চরম দারিদ্র্য নিরসনে সরকারের ‘একটি বাড়ি একটি খামার’সহ বিভিন্ন উদ্যোগের প্রশংসা করে অতিদারিদ্র্য নিরসনে ব্র্যাকের ‘গ্র্যাজুয়েশনভিত্তিক’ মডেলটিকেও তুলে ধরেন তিনি। এ প্রসঙ্গে বলেন, এই মডেল বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষের অতিদারিদ্র্য নিরসনে গুরুত্বপূর্ণ রেখেছে। এর পাশাপাশি বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশে সেখানকার পরিস্থিতির উপযোগী করে পদ্ধতিটির প্রয়োগ ঘটিয়ে চরম দারিদ্র্য নিরসনের কাজ এগিয়ে চলেছে। বাংলাদেশের দুই কোটি মানুষ যাতে আগামী কয়েক বছরের মধ্যে এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসতে পারেন সে লক্ষ্যে সরকার ও বেসরকারি সংস্থাগুলোকে একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান ব্র্যাক চেয়ারপারসন।

দেশের বর্তমান স্বাস্থ্যসেবা পরিস্থিতি সম্পর্কে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি তথ্য তুলে ধরেন স্যার আবেদ। তিনি বলেন, ২০০০-২০১৫ ব্যাপী সহ¯্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্য অর্জনের দৌড়ে বাংলাদেশ স্বাস্থ্যখাতে যে-সব অর্জন করেছিল তা বর্তমান সময়ে এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। এক্ষেত্রে মাতৃমৃত্যুর হ্রাসের উদাহরণ তুলে ধরে তিনি বলেন, মাতৃমৃত্যু অনুপাত বা এমএমআর ২০১০ থেকে ২০১৬ সাল সময়কালের মধ্যে প্রতি এক লাখ জীবিত নবজাতক জন্মের বিপরীতে ১৯৬-তে থেমে আছে। কেন এক্ষেত্রে আর অগ্রগতি হচ্ছে না তার কারণগুলো খুঁজে বের করার ওপর জোর দেন তিনি। ‘আমরা যদি মাতৃমৃত্যু অনুপাত আরো কমিয়ে আনতে চাই তবে আমাদের প্রথমেই মায়ের রোগ ও মৃত্যুর প্রত্যক্ষ কারণগুলোকে আগে দূর করতে হবে,’ তিনি বলেন।

‘মিসোপ্রস্টল’ নামের একটি ওষুধের কথা উল্লেখ করে ব্র্যাক চেয়ারপারসন বলেন, ‘দামি এই ওষুধটি সন্তান জন্মের দশ মিনিটের মধ্যে মাকে খাওয়ানো হলে তা প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণ প্রতিরোধ করে। কিন্তু এই ওষুধ আমাদের দেশের মাত্র ১৭ শতাংশ মায়ের জন্য পাওয়া যায়।’ আমাদের দেশের ৩১ শতাংশ মাতৃমৃত্যু ঘটে প্রসব-পরবর্তী রক্তক্ষরণের ফলে। বাংলাদেশে মাঠপর্যায়ের স্বাস্থ্যকর্মীদের বিশাল বাহিনী থাকার পরও আমরা এই ঔষধ তাঁদের কাছে পৌঁছাতে পারছি না। শুধুমাত্র এই একটি ছোট বিষয়ের সমাধানেও বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে বড় এক অগ্রগতি অর্জিত হতে পারে, তিনি বলেন।

‘আমরা যদি ঐক্যবদ্ধভাবে জরুরি পদক্ষেপ নিতে পারি তবে আমি বিশ্বাস করি আমাদের স্বাস্থ্যব্যবস্থায় পুনর্জীবন সঞ্চার হবে এবং আমরা সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা লক্ষ্য অর্জনের দিকে এগিয়ে যেতে সক্ষম হব,’ বলেন ব্র্যাক প্রতিষ্ঠাতা।

বাংলাদেশ বিস্ময়কর গতিতে সর্বজনীন প্রাথমিক শিক্ষার ভর্তি বিষয়ক লক্ষ্য অর্জন করলেও শিক্ষার মানোন্নয়নের কাজে সেই গতির সঞ্চার করা যাচ্ছে না, বলেন তিনি। উদাহরণ হিসাবে প্রাকপ্রাথমিক শিক্ষার প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, ‘সরকার প্রাথমিক বিদ্যালয়গুলোতে প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষার জন্য হাজার হাজার শ্রেণিকক্ষ প্রতিষ্ঠা করেছে। কিন্তু এর পরিবেশ শিশু শিক্ষার্থীর জন্য উপযোগী নয়। প্রাক-প্রাথমিক শিশুদের প্রয়োজন মেটাতে হলে শিক্ষকদের উপযুক্ত পরিচিতিমূলক ধারণা, প্রশিক্ষণ ও সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। এক্ষেত্রে শিক্ষক মূলত সহায়কের ভূমিকা নেবেন। পাশাপাশি শ্রেণিকক্ষের চেহারাও খুব ভিন্নরকম হতে হবে যেখানে শিশু খেলতে খেলতে শিখবে। এক্ষেত্রেও ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করার মধ্য দিয়ে এবং পরস্পরের শক্তির জায়গাগুলোকে কাজে লাগিয়ে আমরা সকল পর্যায়ের শিক্ষার মান উন্নয়ন করতে পারি।’

বক্তব্যের শেষে সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও উন্নয়নের ওপর বিশেষ জোর দিয়ে তিনি বলেন, ‘সুশাসনের অভাব অতীতের মতো বর্তমান সময়েও বাংলাদেশের জন্য সুকঠিন চ্যালেঞ্জগুলোর একটি। এই সমস্যাকে আরো গুরুত্বের সঙ্গে নিয়ে সমাধানের পথে যেতে না পারলে আমাদের দেশ এ পর্যন্ত যেসব সামাজিক-অর্থনৈতিক সাফল্য অর্জন করেছে তার অনেকগুলোই হারিয়ে যেতে পারে।’ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো সংস্কারের ক্ষেত্রে সুশীল সমাজকে সম্পৃক্ত করতে সরকারের প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

দারিদ্র্য বিমোচন, শিশুমৃত্যু হ্রাস, জন্মহার হ্রাসসহ অতীতের অনেক সফল উদ্যোগে সরকার ও সুশীল সমাজ একত্রে কাজ করার কথা উল্লেখ করে স্যার আবেদ পরিশেষে বলেন, ‘একত্রে কাজ করার মধ্য দিয়ে এমডিজি-পূর্ববর্তী ও এমডিজি সময়কালীন আমরা অনেক গুরুত্বপূর্ণ সাফল্য অর্জন করেছি। এসডিজি বাস্তবায়নের মাধ্যমে ২০৩০ সালের লক্ষ্যমাত্রা অর্জনেও সে ধরনের জোরদার সমন্বিত কর্মকা-ের সুযোগ তৈরি করা সম্ভব বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।’

1 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments