‘জামদানি’ যেভাবে
ফিরে পেলাম

October 10, 2019

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৮ সালে নাটকীয় এক পরিবর্তন এলো জামদানির ক্ষেত্রে। ‘আড়ং’ সবেমাত্র জন্মেছে। শুরু থেকেই দেশি কাপড় এবং বাংলার লোকজ নকশা আর এদেশের ঐতিহ্য নিয়ে ‘আড়ং’ কাজ করতে থাকে।

কঠিন পাথরের রত্ন নয়, বরং নরম তুলোয় তৈরি এক অমূল্য ধন। এতে শিল্পীর হাতের ছোঁয়ায় এমনই অসামান্য কারুকাজ খচিত হয়, যার সৌন্দর্যে বিমোহিত হয়েছিল সারাবিশ্ব। সমঝদাররা বোঝেন এবং বলেন, মানুষের সৃজনশীলতার ইতিহাসে আজ অবধি এ এক অপার বিষ্ময়! মোঘল আমল থেকে শুরু করে ইংল্যান্ডের রানী, কে না তারিফ করেছে এর নান্দনিকতার! হ্যা, বলছিলাম ‘জামদানি’-র কথা।

জামদানির জন্ম হয়েছিল আদি ঢাকায়। অথচ শুধুমাত্র বাণিজ্যিক কারণে পৃথিবীর ইতিহাস থেকে এর অস্তিত্বকে মুছে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়েছিল! কিন্তু কিছু মানুষের আন্তরিক চেষ্টা আর দৃঢ় সংকল্প তা হতে দেয়নি। ঢাকা জেলার সোনারগাঁও, তিতাবাড়ি, বাজিতপুর অঞ্চলে এককালে তৈরি হতো ভুবনখ্যাত জামদানি শাড়ি। বংশ পরম্পরায় কয়েক পুরুষের হাত ধরে এর সূক্ষ্ম বয়নকৌশল আর নকশার নৈপুণ্য ইতিহাসে ঠাঁই পেয়েছিল।

জামদানির উল্লেখ পাওয়া যায় আনুমানিক ৩শ খ্রিষ্টাব্দে কৌটিল্য রচিত ‘অর্থশাস্ত্র’ গ্রন্থে। বঙ্গ আর পুন্ড্র অঞ্চলে অতি মসৃন এবং সূক্ষ্ম এক ধরনের কাপড়ের প্রচলন ছিল, সেকথা ‘অর্থশাস্ত্র’ থেকে জানা যায়। খ্রিষ্টীয় চতুর্দশ শতাব্দীতে মরক্কোর বিখ্যাত পর্যটক মুহাম্মাদ ইবনে বতুতা তাঁর বর্ণনায় বাংলাদেশের সূক্ষ্ম সুতির কাপড়ের প্রশংসা করেন। তারপরে ষোড়শ শতকের শেষ দিকে ইংরেজ ব্যবসায়ী ও পর্যটক রালফ ফিচ এবং ঐতিহাসিক আবুল ফজল তাদের নিজ নিজ বিবরণে বাংলার মসলিন ও জামদানির সূক্ষ্মতার তারিফ করেছেন। সম্রাট জাহাঙ্গীরের আমলে উৎকৃষ্ট সূক্ষ্ম মসলিনের দাম ছিল তখনকার হিসেবে প্রায় ৪শ টাকা। বলাবাহুল্য মোঘল আমলেই জামদানি শিল্পের প্রসার হয় সবচেয়ে বেশি। তাদেরই পৃষ্ঠপোষকতায় বাংলা ছাড়িয়ে সারাবিশ্বে জামদানি পায় বিলাসি পণ্যের সম্মান। অষ্টাদশ শতকের এক ইংরেজি দলিল থেকে জানা যায়, সে সময় মসলিন সংগ্রহ করার জন্য মোঘল রাজ্যে দারোগা-ই-মখমল পদে রাজকর্মচারী নিয়োগ দেওয়া হতো। তার কাজ ছিল মসলিন ও জামদানি শাড়ি উৎপাদনের দিকে বিশেষভাবে নজর রাখা। সেকালে শুধুমাত্র ঢাকা থেকে ১ লক্ষ টাকা মূল্যের খাস মসলিন মোঘল রাজদরবারে পাঠানো হতো।

তবে ইংরেজরা এদেশে আসার পরে জামদানির কদর কমতে থাকে। কারণ বস্ত্র ব্যবসায় নিজেদের আধিপত্য বিস্তার করার জন্যই তারা তখন মরিয়া হয়ে উঠেছিল। সুতরাং ঢাকার কারিগরদের ওপর শুরু হয় পাশবিক নির্যাতন। প্রচলিত রয়েছে যে, ওই সময় কোনো কোনো কারিগরের হাতের আঙুল পর্যন্ত কেটে নেওয়া হয়েছিল! অনেকেই ইংরেজদের রোষ থেকে বাঁচার জন্য পূর্বপুরুষের পেশা ছেড়ে দিতে বাধ্য হন। আস্তে আস্তে জামদানি শিল্প পতনের দিকে এগোতে থাকে, পড়তে থাকে সুতোর বাজার। এর ফলে কমে যায় সূক্ষ্ম সুতোর চাহিদা। জামদানির হারিয়ে যাওয়ার সেই শুরু। ইংল্যান্ডে শিল্পবিপ্লব যখন হয়, তখন যন্ত্রে তৈরি স্বস্তা বিদেশি সুতোর সঙ্গে পাল্লা দিতে না পেরে দেশি সুতোর বাজার হয়ে যায় ধ্বংস। বাজারে সুতো নেই, কাজেই জামদানির উৎপাদনও পুরোপুরি বন্ধ হয়ে যায়। বংশ পরম্পরায় চলে আসা পেশা থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন জামদানি শাড়ি তৈরির কারিগরেরা। এর ফলে বাংলার অতি পরিচিত জামদানির নকশাগুলো হারিয়ে যায়। পরের ১শ বছরের ইতিহাস বাংলা থেকে ধীরে ধীরে জামদানির হারিয়ে যাওয়ার ইতিহাস।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ১৯৭৮ সালে নাটকীয় এক পরিবর্তন এলো জামদানির ক্ষেত্রে। ‘আড়ং’ সবেমাত্র জন্মেছে। শুরু থেকেই দেশি কাপড় এবং বাংলার লোকজ নকশা আর এদেশের ঐতিহ্য নিয়ে ‘আড়ং’ কাজ করতে থাকে। অল্প সময়ের মধ্যে বয়ন শিল্পী আর দেশি কাপড়ের গ্রাহকদের কাছে আস্থার জায়গা তৈরি করে নেয় ‘আড়ং’। সে সময় স্যার ফজলে হাসান আবেদ জামদানি শিল্পকে নিয়ে কিছু একটা করবেন বলে ভাবেন। তিনি তখন ঢাকা জেলার ডেমরা এলাকাতে জামদানি শিল্প আর শিল্পীদের বর্তমান অবস্থা জানার জন্য জরিপ পরিচালনা করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। সেই জরিপের মাধ্যমে বেরিয়ে আসে যে, ডেমরা এলাকার ৭শ পরিবার জামদানি শাড়ি তৈরির কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত ছিল!

জরিপে পাওয়া তথ্য থেকে এও জানা গেল যে, ডেমরার যে পরিবারগুলো জামদানি তৈরির কাজে যুক্ত ছিলেন তারা নতুনতর রুচির চাহিদার সঙ্গে তাল মিলিয়ে চলতে না পেরে জামদানি তৈরি বন্ধ করে দিচ্ছিলেন। কেউ কেউ পেশা বদল করে অন্য পেশাতেও চলে যাচ্ছিলেন। স্যার ফজলে হাসান আবেদ কীভাবে হারানো ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনা যায়, তা নিয়ে চিন্তা করতে লাগলেন। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, গত দুশ বছর ধরে যত জামদানি তৈরি হয়েছে, সেগুলোর নমুনা সংগ্রহ করবেন। কিন্তু মুশকিল হলো জামদানির সেই আদি মোটিফ বা নকশাগুলো তখন আর কারও কাছেই নেই। কারণ সেই নকশার জ্ঞান তো হাত বদল হতো এক কারিগর ওস্তাদের কাছ থেকে অন্য কারিগর সাগরেদের কাছে। স্যার ফজলে হাসান আবেদ জানতেন, পৃথিবীর অনেক জাদুঘরে জামদানি সংরক্ষণ করে রাখা আছে। ভারতের আহমেদাবাদ কালিকা জাদুঘর, কলকাতার আশুতোষ জাদুঘর, আমেরিকার শিকাগো জাদুঘরসহ আরও অনেক দেশের জাদুঘরেই ছিল জামদানির নমুনা। জামদানি ছড়িয়ে রয়েছে বিশ্বব্যাপী, অথচ আমাদের জামদানি নেই আমাদের কাছে! কিন্তু এখন এসব জামদানি কীভাবে সংগ্রহ করা যাবে? জাদুঘর থেকে তো আর এগুলো নিয়ে আসা সম্ভব নয়। তখন তিনি বিভিন্ন দেশের জাদুঘরে ঘুরে ঘুরে সব জামদানির ছবি তুলে স্লাইড করে নিয়ে এলেন। এভাবে গত ২শ বছরে করা ১৩০টি জামদানির নকশা স্লাইডের মাধ্যমে উদ্ধার করা হলো। এরপর সেই নকশার স্লাইডগুলো স্যার আবেদ তুলে দিলেন আড়ংয়ের কাছে। ‘আড়ং’ সেই নকশাগুলো নিয়ে গেল জামদানি শাড়ি তৈরির কারিগরদের কাছে। বেশ কয়েকজন ওস্তাদ কারিগরকে একত্র করে তাদেরকে দিয়ে স্লাইড থেকে জামদানি শাড়ির নকশা তৈরি করতে আরম্ভ করল ‘আড়ং’। এভাবেই শুরু হলো নতুন করে জামদানি তৈরির কাজ। গত ২শ বছরে যতরকম জামদানি তৈরি হয়েছে, তার সবগুলো মোটিফ ব্যবহার করে তৈরি হলো ৩শ জামদানি শাড়ি।

১৯৮১ সালে সেই শাড়িগুলো নিয়ে ঢাকার শিল্পকলা একাডেমিতে জামদানি শাড়ির প্রথম প্রদর্শনীর আয়োজন করা হলো। দায়িত্বে ছিলেন পুতুল হোসেন। কারিগর আর তাদের নিজ হাতে তৈরি জামদানি শাড়ি নিয়ে যে এরকম একটা প্রদর্শনীর আয়োজন করা যেতে পারে, তা ঢাকার মানুষ সেবারই প্রথম বুঝতে পারল। একইভাবে জামদানি তৈরির কারিগরেরাও বুঝতে পারলেন যে, তাদের প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। যে শিল্প বংশপরম্পরায় তাদের রক্তের ভেতর দিয়ে বয়ে গেছে, তাকে বাঁচিয়ে রাখার প্রয়োজনটাও তখন তারা অনুভব করলেন। এরপর ২০০৮ সালে আবারও জামদানি শিল্পকে এগিয়ে নেওয়ার আরেকটি উদ্যোগ নেয় ‘আড়ং’। দু বছর সময় ব্যয় করে আধুনিক ধ্যানধারণা আর জামদানির আদি নকশার মিশেলে ১৩০টি জামদানি শাড়ি তৈরি করা হয়। সেই শাড়িগুলো নিয়ে আবারও প্রদর্শনীর আয়োজন করে ‘আড়ং’। এবারের প্রদর্শনীর ব্যাপারে সবচেয়ে বেশি আগ্রহ দেখায় তরুণ প্রজন্ম। তারা বুঝতে পারে বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী এই শিল্পকে পুরানো ফ্যাশন বলে অবহেলা করার কোনো সুযোগই নেই। আভিজাত্য আর ঐতিহ্য একসঙ্গে মিলেমিশে একাকার হয়ে যায় নতুন জামদানির নকশায়।

এই প্রদর্শনী হওয়ার পরে আড়ংকে আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। ২০১৬ সালে আড়ং, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর ও দৃক পিকচার লাইব্রেরির যৌথ উদ্যোগে মসলিন প্রদর্শনী ও মসলিন পুনরুজ্জীবন উৎসবের আয়োজন করা হয়। মসলিন তৈরির প্রধান উপকরণ ‘ফুটি কার্পাস তুলো’ দিয়ে নতুন করে বাংলাদেশে মসলিন তৈরির খবরটি প্রদর্শনীর কারণে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়। এরই ফলস্বরূপ ২০১৯ সালে জামদানি উৎসব জাতীয়ভাবে উদযাপিত হয়।

এককালের হারিয়ে যাওয়া বুনন শিল্প বাংলায় ফিরে এসেছে। ঠিকমতো তুলে ধরা হলে আমাদের হারানো ঐহিত্য ফিরে পাবে তার হৃতগৌরব। বিশ্ববাসী বাংলা ও বাঙালির গৌরবময় ঐতিহ্য জামদানি শাড়ির চমৎকার নান্দকিতার স্পর্শে হবেন উদ্বেলিত। আর আমাদের অঙ্গীকারের সীমানা হবে বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত ও প্রসারিত।

3.7 3 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments