সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের খাদ্দামা বলে। খাদ্দামাদের কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা এখানকার সবাই জানে। কাজেই আমরা আমাদের মা-বোনদের এভাবে নির্যাতিত হতে দিতে পারি না। বাংলাদেশ সরকারের কোনোভাবেই এখানে নারীদের পাঠানো ঠিক হবে না।
গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে দেশে ফিরেছেন কেউ কেউ। কাউকে পিটিয়ে হাত পা ভেঙে দেওয়া হয়েছে। আয়রন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে শরীর। প্রতিবাদ করায় এক নারীর চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হয়েছে। নির্যাতনের কারণে চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়ে একজন হাসপাতালের আইসিইউতে ছিলেন অনেক দিন। আরও কতো ধরনের নির্যাতন নিয়ে যে রোজ বাংলাদেশের মেয়েরা মধ্যপ্রাচ্য বিশেষ করে সৌদি আরব থেকে ফিরছে সেগুলো বলে শেষ করা যাবে না।
গত তিন মাসে বিভিন্ন ধরনের নির্যাতনের শিকার হয়ে অন্তত সাড়ে পাঁচশ নারী সৌদি আরব থেকে দেশে ফিরেছেন। বছরের শুরু থেকে হিসাব করলে গত সাত মাসে ১ হাজার ৪০০ নারী সৌদি আরব থেকে ফিরেছেন। এই নারীদের অনেকের বাড়িতে ফেরার মতো পরিস্থিতি থাকে না। ফেরত আসার খবর পরিবারের সদস্যরাও অনেক সময় জানতেও পারেন না। আর সবার মতো নয়, বিমানবন্দরে তারা ফেরেন এক কাপড়ে। তাদের কান্নায় থমকে যায় সবকিছু।
ফেরত আসা এই মেয়েদের সহায়তা দিতে জরুরী সহায়তা কর্মসূচি শুরু করেছে ব্র্যাক। ফলে যখনই কোন মেয়ে ফিরছে যেতে হচ্ছে আমাদের বিমানবন্দরে। ফিরে আসা মেয়েরা কষ্টের যেসব বিবরণ দেন, নির্যাতনের যেসব চিহৃ দেখান সেগুলো সহ্য করা কঠিন। প্রশ্ন হলো আর কতো নির্যাতন হলে, আর কতো মেয়ে ফেরত এলে আমরা নির্যাতন বন্ধ করতে পারবো?
১৯৯১ থেকে ২০১৮ সালের জুন পর্যন্ত সাড়ে সাত লাখ নারী নারী বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে আড়াই লাখই গেছেন সৌদি আরবে। এছাড়া জর্ডানে এক লাখ ৩৩ হাজার, আরব আমিরাতে এক লাখ ২৭ হাজার, লেবাননে এক লাখ চার হাজার, ওমানে ৬৯ হাজার, কাতারে ২৭ হাজার এবং মরিশাসে ১৬ হাজার নারী গেছেন। জর্ডান ও লেবাননে পোষাক কারখানায় কাজ করতে যাওয়া অধিকাংশ মেয়ে ভালো অবস্থায় আছেন, এমন তথ্য নানাভাবেই মিলছে। এর বাইরে অন্য দেশগুলোয় গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া অনেকেই ভালো নেই এর মধ্যে সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সৌদি আরবে।
বছর দশেক আগে সৌদি আরব প্রথম বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী চায়। ততোদিনে সাংবাদিকতা করতে গিয়ে আমি জেনেছি জর্ডান, লেবানসহ আরও কিছু জায়গায় গৃহকর্মী হিসেবে যাওয়া বাংলাদেশি মেয়েরা নির্যাতনের শিকার। সাত বছর আগে আনুষ্ঠানিকভাবে সৌদি আরব যখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী চাইলো তখন এ ঘটনা নিয়ে ২০১১ সালের ৭ মে প্রথম আলোতে ‘সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মী পাঠানো নিয়ে উদ্বেগ, কয়েকটি দেশের তিক্ত অভিজ্ঞতা, সরকারের নিরাপত্তার আশ্বাস’ শিরোনামে একটি রিপোর্ট করলাম।
ওই রিপোর্টে উঠে এসেছিল, সৌদি আরবে গৃহকর্মী হিসেবে কাজ করতে যাওয়া ইন্দোনেশীয়, ফিলিপাইন ও শ্রীলঙ্কার নারীরা শারীরিক ও মানসিক নির্যাতনের শিকার হয়েছেন।
নির্যাতনের কারণে এই দেশগুলো যখন তাদের নারীদের সৌদি আরবে পাঠানো বন্ধ করে দিচ্ছে, তখন বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী নিতে আগ্রহী হয়ে উঠেছে দেশটি। কিন্তু নিরাপত্তা সম্পর্কে নিশ্চিত না হয়ে বাংলাদেশ সরকারের সেখানে নারী গৃহকর্মী পাঠাতে আপত্তি করেছেন সংশ্লিষ্টরা।
সৌদি প্রবাসী বাংলাদেশি সায়েদুল হাসান, কুমিল্লার ফরহাদ আহমেদ, চট্টগ্রামের বাবুল আহমেদসহ আরও অনেকেই আমাকে সেদিন বলেছিল, সৌদি আরবে নারী গৃহকর্মীদের খাদ্দামা বলে। খাদ্দামাদের কী পরিমাণ দুর্ভোগ পোহাতে হয়, তা এখানকার সবাই জানে। কাজেই আমরা আমাদের মা-বোনদের এভাবে নির্যাতিত হতে দিতে পারি না। বাংলাদেশ সরকারের কোনোভাবেই এখানে নারীদের পাঠানো ঠিক হবে না।
সৌদি আরবে গৃহকর্মীদের নিরাপত্তার বিষয়ে কী করা হবে জানতে চাইলে তখনকার বৈদেশিক কর্মসংস্থান ও প্রবাসী কল্যাণমন্ত্রী খন্দকার মোশাররফ হোসেন বলেছিলেন, ‘নারীদের নিরাপত্তা বিধান করেই সৌদি আরবে পাঠানো হবে। এ নিয়ে দুশ্চিন্তার কিছু নেই।’
ওই নিউজের পর নারীদের বিদেশে যাওয়ার প্রক্রিয়াটি বন্ধ না হলেও কিছুটা গতি হারায়। এভাবে কাটলো আরও চার বছর। সৌদি আরবে তখনো পুরুষ কর্মী পাঠানো বন্ধ। তারা বারবার চাপ দিচ্ছে বাংলাদেশ থেকে নারী গৃহকর্মী দিতে হবে। ২০১৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাস। সৌদি আরবের শ্রম মন্ত্রণালয়ে উপমন্ত্রী আহমেদ আল ফাহাইদের নেতৃত্বে ১৯ সদস্যের প্রতিনিধিদল ঢাকায় আসে। এবার তারা নারীদের নেবেই। চুক্তি স্বাক্ষর করলো বাংলাদেশ। সেদিনও এই প্রক্রিয়ার সমালোচনা তুলে ধরে খবর প্রকাশ করেছিলাম। যা ১১ ফেব্রুয়ারি তারিখে ‘৮০০ রিয়ালে নারী গৃহকর্মী, সৌদি আরবে জনশক্তি রপ্তানির চুক্তি, শিরোনামে প্রকাশিত হয়।
ওই সংবাদে উঠে আসে- ১২০০ রিয়াল থেকে ১৫০০ রিয়াল বেতনের কথা বলা হলেও শেষ পর্যন্ত ৮০০ রিয়ালেই (১৬ হাজার ৮০০ টাকা) গৃহকর্মী পাঠাতে রাজি হয়েছে বাংলাদেশ। এতো কম বেতনে গৃহকর্মী পাঠানোর চুক্তি করায় এবং নারী গৃহকর্মীদের নিরাপত্তা নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে সৌদি আরবপ্রবাসী বাংলাদেশি এবং অভিবাসীদের নিয়ে কাজ করা বেসরকারি সংস্থাগুলো।
সেদিন প্রবাসীকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা বলেছিলেন, সৌদি আরব দীর্ঘদিন পর বাংলাদেশ থেকে কর্মী নিতে রাজি হয়েছে। কাজেই চাইলেও তাদের প্রত্যাখ্যান করার সুযোগ ছিল না। আর গৃহকর্মী নেওয়ার পর অন্যান্য খাতেও কর্মী নেওয়ার আশ্বাস দিয়েছে দেশটি। বাংলাদেশি মেয়েরা যেন কোনো বিপদে না পড়ে, সে জন্য সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে বাংলাদেশ।
অধিকারকর্মীরা সে সময় বারবার সতর্ক করলেও কেউ কথা শোনেনি। ব্যবসায়ীরা উঠে পড়ে লাগলেন। সারাদেশে দালালরা সক্রিয় হলো। ২০১৫ সালে গেলেন ২১ হাজার নারী শ্রমিক। ২০১৬ সালে গেলেন ৬৮ হাজার। এই মেয়েরা কেমন থাকলেন? পরে এই মেয়েদের দুরাবস্থা নিয়ে ফলোআপ স্টোরি আমিই করলাম ২০১৬ সালের ৯ এপ্রিল। শিরোনাম- মধ্যপ্রাচ্যে নির্মম নির্যাতনের শিকার বাংলাদেশি মেয়েরা।
সেই নিউজে উঠে এল, সংসারে সচ্ছলতার আশায় কুড়িগ্রাম থেকে যাওয়া এক নারী গৃহকর্মী হিসেবে সৌদি আরবে গিয়ে গৃহকর্তার ধর্ষণের শিকার হয়ে তিনি অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন। পরে জীবন বাঁচাতে পালিয়ে আশ্রয় নেন রিয়াদের বাংলাদেশ দূতাবাসে। দুই মাস পর তিনি দেশে ফিরেন।
ঢাকার উত্তর বাড্ডার এক নারী বলেছিলেন, যে বাসায় তিনি কাজ করতেন, ওই বাসার পুরুষেরা তাঁকে শারীরিক নির্যাতন ও যৌন হয়রানি করত। প্রতিবাদ করলে তাঁর চুল টেনে টেনে তুলে ফেলা হতো। মানিকগঞ্জেরে এক মেয়ে বলেছেন, সৌদি আরবের বনি ইয়াসার এলাকায় কাজ করতেন তিনি। নির্যাতনের কারণে চারতলা বাড়ির ছাদ থেকে লাফিয়ে পড়েন। পরে তার স্থান হয় হাসপাতালের আইসিইউতে। কুমিল্লার এক নারীকে নির্যাতন করে মাথা ফাটিয়ে দিলে ১৪টি সেলাই লাগে।
এখন তো রোজই মেয়েরা ফিরছে। নির্যাতনের যে বর্ণনা দেন তারা সেগুলো শুনলে গায়ের সব লোম দাঁড়িয়ে যায়। কান্নায় ভিজে যায় চোখ। সাংবাদিকতা ছেড়ে গত বছরের জুলাই মাসে বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাকের মাইগ্রেশন প্রোগ্রামের প্রধান হিসেবে যোগ তেই। এর মধ্যেই এ বছরের শুরু থেকেই জানতে পারি নানা রকম নির্যাতনের কারণে সৌদি আরব থেকে মেয়েরা ফিরছে। তাদের পাশে কেউ নেই। এরপর ব্র্যাকের সব পরিচালনা পরিষদকে জানালে তারা এই মেয়েদের সহায়তায় জরুরী তহবিল দেয়। এরপর থেকে নাওয়া খাওয়া ভুলে আমাদের লোকজন যাচ্ছেন রোজ বিমাবন্দরে। সেখানকার পুলিশ, কল্যাণ ডেস্ক সবাই মিলে অসহায় এক কাপড়ে আসা মেয়েগুলোকে জরুরী খাবার, চিকিৎসা ও মানসিক স্বাস্থ্য সেবা দিচ্ছি আমরা। এখন রোজই আমাদের শুনতে হচ্ছে মেয়েদের কান্না। সেই কান্না ইতোমধ্যেই বিমানবন্দর থেকে পৌঁছে গেছে সারাদেশে।
সরকার বলার চেষ্টা করে এই যে আড়াইলাখ মেয়ে গেল তার মধ্যে মাত্র তো ছয় হাজার ফিরলো। বাকিরা নিশ্চয়ই ভালো আছে। ভালো আছে কী নেই, সেটা আমরা জানতে পারি না। কারণ সৌদি আরবের সেই বাড়িগুলোতে যাওয়ার অধিকার কারও নেই। আমাদের পর্যবেক্ষণ ব্যবস্থাও দুর্বল। কিন্তু অনেক মেয়েই যে ভালো আছে সেটা সত্য। আবার অনেক মেয়ে যে নির্যাতিত সেটা কী করে অস্বীকার করা যায়? আর মানবাধিকার লংঘনের ঘটনা তো সংখ্যা দিয়ে বিচার করা যায় না। সৌদি আরবে যদি একটা মেয়েও নির্যাতিত হয়ে কাঁদে সেই কান্না কী পুরো বাংলাদেশের নয়?
মেয়েদের বিদেশে পাঠানোর বিপক্ষে আমরা বলছি না। আমাদের মেয়েরা বিদেশে কাজ করতে যাক, তবে সেটা গৃহকর্মী না হয়ে অন্য কিছু হলে ভালো হয়। বিশেষ করে পোষাক খাত বা অন্য কোন কাজে। তারপরেও যদি সরকার পাঠাতে চায় তাদের পুরোপুরি নিরাপত্তা নিশ্চিত করুক। এছাড়াও যারা নির্যাতন করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হোক। অন্তত একটি মামলা হলেও হোক। দূতাবাসগুলোতে জনবল দেয়া হোক। নিয়মিত তারা নজরদারি করুক। আমরা চাই না বিদেশে কাজ করতে গিয়ে বাংলাদেশের একটা মেয়েও নির্যাতনের শিকার হোক। কারণ একটা মেয়েও যদি কাঁদে আমার কাছে সেটা পুরো বাংলাদেশের কান্না। চলুন আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে কাজ করে এই কান্না বন্ধ করি।