ঢাকায় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের কার্যালয়ে নারী ভারোত্তলকের ধর্ষিত হওয়ার সংবাদ পড়ে যতটা নাড়া খাওয়ার কথা ছিল ভেতর থেকে ততটা নাড়া খাইনি। তার কারণ, শুধু আমাদের দেশে নয়, সারা বিশ্বে নির্দোষ, পরিচ্ছন্ন বলে খেলার মাঠ সম্পর্কে যে ভাবমূর্তি আছে তা সম্প্রতি ভেঙে খানখান হতে শুরু করেছে।
নারী খেলোয়াড়দের ধর্ষণ ও যৌন হয়রানি বিষয়ে বিশ্বকে নাড়িয়ে দেওয়া সংবাদ সম্ভবত গত বছরই প্রথম প্রকাশিত হয়েছে। অলিম্পিক পদকজয়ী জিমনাস্ট ম্যাককেইলা মারোনি গত অক্টোবরে মিটু আন্দোলনে সাড়া দিয়ে নিজের ওপর হওয়া ভয়াবহ যৌন নির্যাতনের কথা প্রকাশ করেন।
তাঁর অভিযোগ সেদেশে জিমনাস্টদের অভিভাবক সংস্থা ইউএসএ জিমনাস্টিকস-এর চিকিৎসক ল্যারি নাসারের বিরুদ্ধে। এই লোকের বিরুদ্ধে অবশ্য আরো আগে থেকেই যৌন হয়রানির অভিযোগ প্রকাশ্যে আসতে শুরু করেছিল। ভুক্তভোগী নারীদের একটি দল ২০১৬ সালে নাসারের বিরুদ্ধে প্রথম মামলা করেন। মারোনি যখন টুইটারে তাঁর নির্যাতিত হওয়ার কথা প্রকাশ করেন ততদিনে ল্যারি নাসার একাধিক মামলায় কাঠগড়ায় দাঁড়িয়ে। তবে মিটু’র মাধ্যমে লোকটির অপরাধ সারা বিশ্বের গণমাধ্যমের নজরে আসে।
ল্যারির নারকীয় অপরাধের শিকার নারীরা জানিয়েছেন কীভাবে চিকিৎসার আড়ালে সে তার রোগীদের ধর্ষণ করেছে, আরো নানাভাবে যৌন নিপীড়ন করেছে। মামলাগুলোতে অভিযোগ উঠেছে ইউএসএ জিমনাস্টিকস, মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিসহ সব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধেও যাদের জন্য সে কাজ করেছে।
অভিভাবকরা অনেক বিশ্বাস আর আস্থার জোরে তাঁদের শিশুকন্যাদের ইউএসএ জিমনাস্টিকসের অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোতে পাঠিয়েছেন। অথচ প্রতিষ্ঠানটি সেই আস্থার প্রতিদান দিতে, তাঁদের কন্যাদের রক্ষা করতে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে।
দুটি মামলায় প্রায় আড়াইশ’ বছরের জেল হয়েছে নাসারের। এর জেরে ইউএসএ জিমনাস্টিকস তার কর্তৃত্ব হারাতে বসেছে।
এবার আসি আমাদের জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের বিল্ডিংএ ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনায়। ধর্ষণের শিকার খেলোয়াড়ের পরিবার সাংবাদিকদের জানিয়েছে, এ বছর সেপ্টেম্বর মাসের ১৩ তারিখে পুরানো জাতীয় ক্রীড়া পরিষদের চারতলায় ভারোত্তলন ফেডারেশনের অফিস সহকারী সোহাগ আলী জাতীয় স্বর্ণপদক জয়ী এই ভারোত্তলককে ধর্ষণ করে। ফেডারেশনের ডাকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ভারোত্তলকরা সেসময় জাতীয় ক্রীড়া পরিষদে অবস্থান করছিলেন। ঘটনার পর মেয়েটি কাউকে কিছু না জানিয়ে বাড়ি চলে যান। একসময় বাড়ির পেছনের পুকুরে ডুবে আত্মহত্যার চেষ্টা করেন। এসময় পরিবারের লোকজন তাঁকে উদ্ধার করেন এবং ঘটনা সম্পর্কে জানতে পারেন।
এরপর তাঁরা ঢাকায় এসে ভারোত্তলন ফেডারেশনকে ঘটনাটি জানালে তাঁরা একটি তদন্ত কমিটি করেন এবং পরিবারটিকে কিছু টাকা দেন। গুরুতর অসুস্থ অবস্থায় তাঁকে মানসিক হাসপাতালে ভর্তি করা হয়।
এই ঘটনায় ফেডারেশন যে সাড়া দিয়েছে পত্রিকায় তার বিবরণ পড়ে ল্যারি নাসারের কথা মনে হয়েছে আমার। মনে প্রশ্ন জেগেছে, ক্রীড়া পরিষদ কর্তৃপক্ষের এক্ষেত্রে যে সাড়া দেওয়া উচিত ছিল তা কি তারা দিয়েছে? ভারোত্তলন ফেডারেশনের সহসভাপতি উইং কমান্ডার মহিউদ্দিন আহমেদ তদন্ত কমিটি গঠনের কথা বলেছেন। অথচ ধর্ষিতার পরিবার মামলা করতে চাইলে তিনি তাদের বলেছেন, ”এটা আপনাদের ব্যাপার।” ফেডারেশনের পুরো আচরণে একটা উপেক্ষার ভাব যেন স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।
যে মেয়েটির নিরাপত্তার দায়িত্ব তাঁদের সেই দায়িত্ব পালন করতে তাঁরা ব্যর্থ হলেন। তাঁদের নিজেদের কর্মচারীর দ্বারা নিজেদের বিল্ডিংএ অপরাধ সংঘটিত হলো। ধর্ষণ একটি গুরুতর ফৌজদারী অপরাধ। লোকলজ্জার ভয়ে অনেক পরিবার মামলায় যেতে চান না, অথচ এক্ষেত্রে অনেক ভয়-দ্বিধা কাটিয়ে মেয়েটির পরিবার যখন মামলা করতে চাইল তখন ফেডারেশন “আপনাদের ব্যাপার” বলে সব দায়িত্ব শেষ করে ফেলল। তাঁরা দায়িত্ব সেরেছেন কিছু টাকা দিয়ে, যেখানে মেয়েটির শারীরিক-মানসিক চিকিৎসার নৈতিক দায়িত্বও তাঁদের ওপরই বর্তায়। উপরন্তু পত্রিকার খবর অনুযায়ী, যে তদন্ত কমিটি তাঁরা করেছেন তারও প্রতিবেদন দেওয়ার সময় ইতিমধ্যে পেরিয়ে গেছে।
একটা ভাল খবর হচ্ছে, ক্রীড়া সংগঠকরা ধর্ষকের শাস্তির জন্য রাস্তায় নেমেছেন, দায়িত্বে অবহেলার জন্য ফেডারেশনের বিরুদ্ধে সোচ্চার হচ্ছেন।
আমাদের দেশে নারীদের খেলার জগৎটা বড়ই ক্ষুদ্র। ছোটবেলায় বাড়ির আঙিনায় একাদোক্কা আর স্কুলের মাঠে খেলাধূলাতেই আমাদের মেয়েদের খেলা শেষ। ইদানীং সেই সীমানা একটু একটু করে বাড়তে শুরু করেছে। প্রত্যন্ত কলসিন্দুরের মেয়েরা ফুটবলে দেশের সীমানা ছাড়িয়ে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, বস্তিবাসী মাবিয়া আক্তার ভারোত্তলনে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে সোনা জিতে আনছেন। মহিলা ক্রিকেট দলের ক্যাপ্টেন সালমার হোর্ডিং ঝুলছে রাজধানীর মোড়ে। এই সাফল্য বাবা-মায়েদের মেয়েদেরকে খেলার মাঠে পাঠাতে উৎসাহ যোগাচ্ছে। আমাদের দেশের বাবা-মায়েরা কন্যা সন্তানের নিরাপত্তা নিয়ে সদাশঙ্কিত থাকেন যেখানে, সেখানে মেয়েদেরকে খেলার মাঠে পাঠানোর সাহস অর্জন কম কথা নয়। সেই সাহস তাঁরা পাচ্ছেন কারণ ক্রীড়া কর্তৃপক্ষ, কোচ বা প্রশিক্ষকদের ওপর তাঁরা ভরসা করতে পারছেন।
বাপ-মায়ের সেই ভরসা, নারী খেলোয়াড়দের সেই ভরসার জায়গা ক্রীড়া প্রতিষ্ঠানগুলো যেন কোনোভাবেই না হারায় সেটি নিশ্চিত করা প্রাথমিকভাবে ক্রীড়া মন্ত্রণালয় ও এর অধীন প্রতিষ্ঠানগুলোর দায়িত্ব। নারী খেলোয়াড়দের উপযুক্ত সুরক্ষা প্রদান এবং যৌন নির্যাতনের অপরাধীদের বিচারের মুখোমুখি দাঁড় করানোর দৃঢ় মানসিকতা এক্ষেত্রে অপরিহার্য। ভারোত্তলন ফেডারেশন সেই ভূমিকায় পিছিয়ে যাবে না আশা করি। দেশের ক্রীড়া সংগঠক ও অধিকার কর্মীরাও বিষয়টির প্রতি কড়া নজর রাখবেন নিশ্চয়ই।