ক্ষুধার হয় না কোনো লকডাউন

April 23, 2020

ক্ষুধার জ্বালায় তাদের মন পোড়ে, বুক ফাটে কষ্টে, হাহাকারে। অনেকেই শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটি মাত্র ঘরে বা আশ্রয়ে গাদাগাদি করে থেকে যাদের দিন কাটে, সামাজিক দূরত্ব মানতে নতুন করে তাদের জীবনে যোগ হলো কমর্হীনতা, খাদ্য সংকট এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

টিন শেডের ছোটো একটি ঘরে সালেহার সংসার। বাইরে মাইকে ঘোষণা দেওয়া হচ্ছে, ঘরের বাইরে যাওয়া যাবে না৷

ভাগ্যের চাকা ফেরাতে মাস্টার্স পাশ করা সালেহা (ছদ্মনাম) রাজধানীতে এসেছিলেন একটি চাকরির আশায়। দুই সন্তানের মা তিনি। বাবা হারা দু’টি ছোট্ট প্রাণের কাছে সালেহা নিজেই সব। যোগ্যতা অনুযায়ী চাকুরি মেলেনি; কোনরকমে ছোটোখাটো একটি ব্যবস্থা সে করে নেয় এই শহরে, ভালোভাবে বাঁচার এই কঠিন পরীক্ষায়।

জীবনযাত্রা কঠিন হলেও চলে তো যাচ্ছিল, কিন্তু বিশ্বব্যাপী যখন করোনার থাবায় সবকিছু স্তব্ধ, সেই ঝাপটা এসে পরে সালেহার ঘরেও৷

অফিস বন্ধের দিন অনেকেই বলেছিল, ঢাকা শহর ছেড়ে গ্রামে চলে যেতে। মায়ের মন তাতে সাড়া দেয়নি, বরং অন্যদের তিনি বুঝানোর চেষ্টা করেছিলেন করোনার ভয়াবহতা সম্পর্কে। এখন মাঝেমধ্যে তার মনে হয়, বাড়ি না গিয়ে ভুল করলাম না তো? মনটা খচ খচ করে। মনে হয় গ্রামে ফিরে যাওয়া উচিত ছিলো। অন্তত নুন-ভাত খেয়েও তো বেঁচে থাকা যেত।

অফিস বন্ধ। বড় কর্তারা বলেছেন, যে কদিন কাজ করেছ শুধু সেই দিনগুলোর টাকা পাবে। সেটাও বা কবে পাওয়া যাবে তার কোন ঠিক নেই।

বৈশাখের এই প্রচণ্ড খরতাপে ক্ষুধায় কাতর ছেলেমেয়ের চোখের জলও যেন শুকিয়ে আসছে। সাথে আছে সংসার খরচ, আছে বাড়ি ভাড়া, পানির বিল, গ্যাসের বিল, বিদ্যুতের বিল- চোখ ঝাপসা হয়ে আসতে থাকে।

সালেহার মতো এরকম কত পরিবার যে সারা দেশ জুড়ে আজ আচমকা এক স্থবিরতার মুখোমুখি তা গুণে শেষ করা যাবে না। তারা চিরকাল একটু ভালো থাকা, কিংবা অদূর ভবিষ্যতে হয়তো ‘কিছু একটা হবে’ এই আশায় বুক বেঁধে থাকে৷

এই নিন্ম মধ্যবিত্ত মানুষগুলোর সামনে বড়ো বাধা হয়ে দাঁড়ায় তাদের আত্মসম্মান। প্রয়োজন থাকলেও ত্রাণ নিতে তাদের দ্বিধা হয়, তীব্র কষ্টের একটি সংকোচে ভুগতে হয়। মানুষগুলো হয়ে ওঠে বিষাদগ্রস্ত। ক্ষুধার জ্বালায় তাদের মন পোড়ে, বুক ফাটে কষ্টে, হাহাকারে। অনেকেই শারীরিক এবং মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েন। একটি মাত্র ঘরে বা আশ্রয়ে গাদাগাদি করে থেকে যাদের দিন কাটে, নতুন করে সামাজিক দূরত্ব মানতে তাদের জীবনে যোগ হলো কমর্হীনতা, খাদ্য সংকট এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ।

এ সবকিছুই মানুষের মনোজগতের জন্য এক বড়ো আঘাত৷ মানবতা আজ আক্রান্ত মরণঘাতী করোনাভাইরাসে। এই মহামারি আমাদের ঠেলে দিয়েছে ঘরে। এর ভয়াবহতায় আমরা আবার নতুন করে হাত ধোয়া শিখছি, পরিচ্ছন্নতা মেনে চলছি। কিন্তু মনের ভেতরও যে ময়লা জমতে শুরু করেছে- সেটা তো পরিষ্কার রাখার ব্যবস্থা প্রয়োজন। আমরা যদি সচেতন না হই, তাহলে করোনা মোকাবিলায় আমাদের প্রতিরোধ হয়ে পড়বে দূর্বল। মানসিকভাবে সুস্থ না থাকলে মানুষ জড়িয়ে পড়বে নানা অনিয়ম, বিশৃঙ্খলায়।

প্রতিবছর বিভিন্ন দুর্যোগ, বিপদ ধেয়ে আসে আমাদের প্রিয় এই দেশে। এই বিপদের ঝাপটা বেশি সামাল দিতে হয় রাজধানী ঢাকাকে। দুর্ভাগা মানুষগুলো রাজধানীকে তাদের জিয়নকাঠি মনে করে ঢাকামুখী হন। বাড়তে থাকে বস্তির সংখ্যা। এদেশের প্রাণকেন্দ্রে এরকম অগনিত বস্তি ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে। জীবিকার তাগিদে আসা জমিহারা ভিটেহীন এই মানুষগুলোকে নিজেদের মতই বেছে নিতে হয় তাদের পেশা। পেটের দায়ে, প্রাণের দায়ে কেউবা চালান রিকশা, কেউ রাস্তার পাশে সবজি বিক্রি করেন; আবার অনেকে হয়েছেন দিনমজুর৷

করোনা সংকটে এই মানুষগুলো আজ ঘরবন্দি। অথচ তারা প্রত্যেকেই তাদের পরিবারের চালিকা শক্তি। দিনশেষের রোজগারই এই মানুষগুলোর মুখের খাদ্য বাহক। আবার রোজগারের এই টাকা থেকে কিছু তার ফেলে আসা গ্রামের বাড়ির বাবা-মা এর চিকিৎসা,  ছোটো ভাইবোনদের পড়াশোনার জন্য পাঠাতে হয়৷

প্রতিদিন বাসা থেকে কর্মস্থলে যেতে আমরা যে পরিবহণ ব্যবহার করি সেই চালকেরা কোথায়? কোথায় আছেন সেই সদাহাস্যময় রিকশাচালক ভাইটি? লেগুনায় চিৎকার করে গলা গুকিয়ে ফেলা ছোট্ট ছেলেটি আজ কোথায়? কিংবা চাররাস্তার মোড়ে সেই জুতো সেলাই করা বৃদ্ধ মানুষটি, একপায়ে চলা সেই ভিক্ষুক? এই করোনাকালীন দুর্যোগে আমরা ক’জনই বা তাদের খোঁজ নিই! দিন শেষে তাদের পেটও কী খালি নেই? তাদের কী ক্ষুধা পায় না?

এই খেটে খাওয়া মানুষগুলোর পরিবারের সদস্যরা একটু খাবারের আশায় পথ চেয়ে থাকেন। শ্রমিকের মাথার ঘামের প্রতিটি ফোঁটায় তার উপার্জনের পথ আঁকা। নির্মাণ শ্রমিক সন্ধ্যায় হিসাবে বসেন কত ঝুড়ি মাটি ফেলা হলো, সেটাই তো তার অন্ন জোগায়। করোনার ছোবলে সব যেন আজ থমকে গেছে। কাজ না থাকলে হাজিরা মেলে না, হাজিরা না পেলে উপোস৷ এই যেন জীবন।

করোনাকে ঠেকাবার হাতিয়ার হলো সচেতনতা৷ যুদ্ধটা ঘরের মধ্যে থেকেই চালাতে হবে৷ বাড়তি সচেতনতা থেকে অনেকে বাড়তি খাদ্যদ্রব্য কিনে বাজার ব্যবস্থাকে আরও অস্থির করে তুলছেন। যার ফলে ভুক্তভোগী শ্রেণি আরও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। এখন প্রয়োজন এই অভাবী মানুষগুলোর পাশে থাকা৷ রাষ্ট্রের পাশাপাশি বেসরকারি পর্যায়ে ইতিমধ্যে অনেক অফিস, সংগঠন, সংস্থা এবং ব্যক্তি পর্যায়েও অনেকে সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে এসেছেন৷

দেশের এই সংকটে মানুষের পাশে এগিয়ে এসেছে ব্র্যাক৷ ২০০,০০০ ছিন্নমূল, দিনমজুর ও অতিদরিদ্র পরিবারকে প্রতিষ্ঠানটি খাদ্য সহায়তা দিচ্ছে। কিন্তু, এরপর না খেয়ে দিনাতিপাত করছেন আরও অনেক অনেক মানুষ। ব্র্যাকের ১০০,০০০ মাঠকর্মী ও স্বেচ্ছাসেবী করোনা প্রতিরোধের লড়াইয়ে দেশের ৬৪টি জেলায় অবিরাম কাজ করে চলেছেন সাহসের সাথে। তারা মানুষকে সচেতন করছেন, শেখাচ্ছেন নিরাপদে বাঁচার উপায়।

করোনা মহামারির এই দিনে সকলকে এগিয়ে আসতে হবে ক্ষুধার্ত মানুষের সহায়তায়, বিপন্ন মানুষের পাশে। ক্ষুধা লকডাউন মানে না। মানুষের সহায়তা ছাড়া মানুষ যে আজ চরম অসহায় তা আর নেই অজানা।

 

সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত ও তাজনীন সুলতানা

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments