ক্লায়েন্টদের সুরক্ষা দিতে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য সহায়তা যেমন প্রয়োজন তেমনি দরকার সচেতনতামূলক বার্তাগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
বাংলাদেশের মতো একটি দেশের জন্য কোভিড -১৯ মহামারি শুধু একটি জনস্বাস্থ্য সংকট নয় বরং তার চাইতে আরও বেশি কিছু। দেশের অর্থনীতি স্থবির হয়ে পড়ায় যারা নানা ধরনের অস্থায়ী এবং অনানুষ্ঠানিক কাজের সাথে যুক্ত তারা প্রবল সংকটের মুখোমুখি; অন্যভাবে বলা যায়, মোট জনবলের ৮০% সবচেয়ে বেশি কষ্টে রয়েছে।
গ্রাম, শহর ও মফস্সল শহরে বসবাসকারী সাধারণ গ্রামীণ উৎপাদক যেমন-ক্ষুদ্র ব্যবসা, ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা, ফেরিওয়ালা সকলের আয়-রোজগার হঠাৎ করে অনেক কমে গেছে। তাদের অনেকেই ব্যবসায় বিনিয়োগ এবং নিজস্ব ব্যয় মেটাতে ক্ষুদ্রঋণের ওপর নির্ভরশীল। ফলে মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠানগুলোকেও কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হতে হচ্ছে।
মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান ক্লায়েন্টদের সহায়তা এবং জনগোষ্ঠীকে দুর্যোগ থেকে রক্ষা করতে কী ধরনের দায়িত্বপালন করবে?
ক্লায়েন্টদের সুরক্ষা দিতে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার জন্য তাদের সহায়তা প্রদান যেমন প্রয়োজন তেমনি দরকার সচেতনতামূলক বার্তাগুলো তাদের কাছে পৌঁছে দেওয়া।
গত ৪৭ বছর ধরে ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্স বাংলাদেশে কার্যক্রম পরিচালনা করছে। মাঠ পর্যায়ের কর্মীরা ব্র্যাকের সামগ্রিক কর্মকৌশলের অংশ হিসেবে আস্থা ও আন্তরিকতার সঙ্গে আর্থিক সেবা প্রদান করে যাচ্ছে যা উন্নয়ন উদ্যোগগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে জড়িত।
এই বিপর্যয়ে সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় যারা আছেন, তাদের পাশে থাকাই আমাদের অঙ্গীকার।
করোনা প্রতিরোধ লড়াইয়ে সবার সামনে থাকা সাহসী কর্মীদের সুরক্ষা
সারা দেশ জুড়ে আমাদের ২০০০-এরও বেশি শাখায়, ৩০ হাজারের বেশি মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মী রয়েছেন। তাদের সুরক্ষার বিষয়টিকে আমরা সর্বাধিক গুরুত্ব দিচ্ছি।
ভাইরাস মোকাবিলায় যে সুরক্ষা ব্যবস্থাগুলো নেওয়া দরকার তা তালিকাভুক্ত করে একটি স্পষ্ট নির্দেশাবলি প্রথমেই পাঠানো হয়েছিল। মুখোশ এবং গ্লাভসের মতো সুরক্ষা সরঞ্জাম সরবরাহ করা হয়েছে এবং আমাদের সহকর্মীরা যেন সুস্থ থাকেন এবং আক্রান্ত না হোন সেজন্য বিভিন্ন প্রতিরোধমূলক পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। ১১,০০০ এরও বেশি মাস্ক এবং প্রায় ১৩,০০০ গ্লাভস মাঠ পর্যায়ের অফিসগুলোতে পাঠানো হয়েছে। কোভিড-১৯ প্রশিক্ষণ সহায়িকা অনুযায়ী দুই সপ্তাহের মধ্যে ২৯,৬৪৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। কর্মীদের ল্যাপটপ ও স্মার্ট ডিভাইস যা তারা কিস্তি সংগ্রহ করতে ব্যবহার করে, সেখানে এই প্রশিক্ষণ সহায়িকার সফট কপি দিয়ে দেওয়া হয়েছে। ক্রেডিট অফিসার এবং অ্যাকাউন্ট অফিসার- যারা নগদ অর্থ আদান-প্রদান করেন তাদের অবশ্যই গ্লাভস এবং মাস্ক পরতে হবে এবং টাকা সংগ্রহের পর খামের ভেতরে তা রাখা ও এরিয়া অফিসে পেমেন্ট দেওয়ার পর সেই খাম নষ্ট করে ফেলার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত ক্লায়েন্টদের সুরক্ষায়
বাংলাদেশ নিয়ন্ত্রক সংস্থার জারিকৃত নির্দেশ অনুযায়ী লকডাউনের একদিন আগে থেকে আমরা ৩০শে জুন পর্যন্ত সবধরনের ঋণ কার্যক্রম বন্ধ রাখার ঘোষণা দিয়েছিলাম। এর অর্থ হলো যারা এ সময়সীমায় কিস্তি পরিশোধ করতে পারবে না তাদেরকে খেলাপি ক্লায়েন্ট হিসেবে ধরা হবে না এবং তাদের ঋণস্থিতি পরিবর্তন করা হবে না। আগামী দুই মাস তাদের কিস্তি দিতে হবে না এবং এর ফলে কোনো বাড়তি সুদ দিতে হবে না। কেউ চাইলে কিস্তি পরিশোধ করতে পারেন তবে নতুন ঋণ বিতরণের ওপর কোনো নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়নি।
২৪শে মার্চ-২রা এপ্রিল ২০২০ তারিখ পর্যন্ত মাঠ পর্যায়ের ঋণ ও সঞ্চয় সংগ্রহের কার্যক্রম স্থগিত রাখা হয়েছে। বর্তমানে এটি ৯ই এপ্রিল পর্যন্ত বর্ধিত করা হয়েছে। আমরা পূর্বে অনুমোদনকৃত ঋণ বিতরণ এবং ক্লায়েন্টরা যেন চাইলে তাদের সঞ্চয় তুলে নিতে পারেন সেজন্য আমাদের শাখা অফিসগুলো খোলা রেখেছি।
সঠিক ও সচেতনতামূলক বার্তাগুলো দ্রুত পৌঁছে দেওয়া
বাংলাদেশ, যে দেশের জনসংখ্যা ১৬ কোটিরও বেশি, যেখানে প্রায় ৮০% মানুষ গ্রামে বাস করে, যেখানে উন্নত ইন্টারনেট সেবা নেই এবং সঠিক তথ্য সরবরাহের ব্যবস্থাও তেমন জোরদার নয়- ভুল তথ্য ও গুজব এখানে দুর্যোগকে কতটা বাড়িয়ে তুলতে পারে তা আমাদের কল্পনারও বাইরে।
এসময় মানুষকে সচেতন করে তোলাই প্রধান লক্ষ্য এবং এই লক্ষ্যপূরণে আমাদের রয়েছে ৩০ হাজারের একটি শক্তিশালী কর্মীদল। বহু বছর ধরে ব্র্যাকের মাঠকর্মীরা দেশের জনগোষ্ঠীগুলোর সঙ্গে নিবিড়ভাবে কাজ করছেন। আমাদের ক্লায়েন্ট ও অংশগ্রহণকারীরা কিছু জানার জন্য বিশেষত এরকম জীবন রক্ষাকারী, নির্ভরযোগ্য তথ্যের জন্য তাদের প্রতি আস্থাশীল।
ক্লায়েন্টরা যেন সংস্থার অন্য কর্মসূচির নেওয়া উদ্যোগগুলোর সুবিধা পেতে পারে সেজন্য সংযোগসেতু হিসেবে কর্মীরা সক্রিয় ভূমিকা পালন করছে।
কোভিড-১৯ সংক্রান্ত প্রশিক্ষণ পাওয়ার পর কর্মীরা বাড়ি বাড়ি গিয়ে মানুষকে সচেতন করছে। আমরা বিভিন্ন অঞ্চলে ৪,৬০০টির বেশি স্থানে হাত ধোয়ার সুবন্দোবস্ত এবং ৫০০০০০- এর বেশি তরল সাবানের ছোটো প্যাক ও প্রায় ৬০০০টি সাবান ক্লায়েন্টদের মাঝে বিতরণ করা হয়েছে। কোভিড-১৯ প্রতিরোধে সচেতনতামূলক বার্তা মাইকিং করা হচ্ছে। গ্রামের রাস্তায় রাস্তায় রিকশার মাধ্যমে এই মাইকিং করা হয়।
আমাদের ক্লায়েন্ট সেবার কল সেন্টারগুলো এখন পর্যন্ত ১০,৯০০ জন ক্লায়েন্টের কাছে কোভিড-১৯ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পৌঁছে দিয়েছে। এপ্রিলের শেষঅব্দি আমরা ৩৩,০০০জন ক্লায়েন্টের কাছে তথ্য পৌঁছে দিতে পারব বলে আশা রাখি। সেইসঙ্গে আমরা ২.৮ মিলিয়ন ক্লায়েন্টের কাছে প্রতিরোধমূলক বার্তা দিয়ে ভয়েস এসএমএস পাঠানোর ব্যবস্থা নিয়েছি।
সত্যিকারের বীর তারাই যারা এই বিপদে মাঠে আছে
ব্র্যাকের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাগণ ফোন করে ও চিঠির মাধ্যমে কর্মীদের প্রেরণা জুগিয়ে যাচ্ছেন। তৃণমূল পর্যায়ের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ও কর্মপরিকল্পনার সমন্বয় করা এই লড়াইয়ে মাইক্রোফাইন্যান্স কমসূচির অন্যতম প্রধান কৌশল।
কিন্তু এত তাড়াতাড়ি সব শেষ হবার নয়, সেজন্য দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা ভবিষ্যতে কী হবে তা এখনও প্রশ্নবিদ্ধ। নিয়ন্ত্রক সংস্থা, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো এবং নীতিনির্ধারকগণ সবাইকে মিলে বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে ভাবতে হবে। সবাইকে একত্রে কাজ করতে হবে যেন লাখো মানুষ, যারা আমাদের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি, তাদের পাশে দাঁড়ানো যায়।