নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা মনিটরিং ও রিপোর্টং এবং প্রয়োজনীয় আইনত ও মনোসামাজিক সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছে ব্র্যাক। পাশাপাশি খাদ্য, নগদ অর্থ, স্বাস্থ্য ও প্রয়োজনীয় তথ্য সেবাসহ সচেতনতা ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম তো চলছেই। মাঠপর্যায়ে আমাদের সহকর্মীরা নিরলস কাজ করছেন নানাবিধ ঝুঁকি নিয়ে, কিন্তু চেষ্টার কোনো কমতি না রেখে।
সবাই আতঙ্কিত, তাই বলে জীবন কি থেমে আছে? জীবন চলছে তার নিজস্ব গতিতেই। আমরা চেষ্টা করছি এই নতুন পরিস্থিতিকে স্বাভাবিক হিসেবে মেনে নিতে।
মহামারির এই সময়ে স্বাস্থ্যঝুঁকির পাশাপাশি বাড়ছে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও মানসিক চাপ। আর এই চাপ মোকাবিলায়ও চলছে নিরন্তর লড়াই। শ্রেণি-পেশা-বয়স-লিঙ্গ-জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সকলের জন্য করোনার এই সংকট নানাবিধ চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করে দিয়েছে। কেউ আমরা এ থেকে মুক্ত নই।
এই সংকট উত্তরণের নিশ্চিত কোনো পথ এখনও আমরা জানি না। সবচেয়ে খারাপ অবস্থায় আছে সাধারণ শ্রমজীবী মানুষ, যারা দিন আনে দিন খায়। অনানুষ্ঠানিক শ্রমখাতে প্রায় ৭০% নারী। কোভিড-১৯ এর সময়ে তাদের লড়াই করতে হচ্ছে সবচেয়ে বেশি! এর মধ্যে আছেন কৃষিকাজের সাথে জড়িত শ্রমিক, গৃহকর্মে, প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী, নির্মাণকাজে যুক্ত, পোশাক শিল্পে ও হস্তশিল্পে নিয়োজিত, হিজরা জনগোষ্ঠী, একক নারী প্রধান পরিবার, যৌনকর্মী, আদিবাসী নারী, দালিত নারী আরও অনেকে।
এই দুর্যোগে বেড়েছে নারীর প্রতি নানা ধরনের বৈষম্য, বঞ্চনা, নির্যাতন ও সহিংসতার ঘটনা, বেড়েছে মানসিক বিপর্যয়। সহিংসতার শিকার নারী ও মেয়েশিশুদের কাছে পৌঁছাচ্ছে না প্রয়োজনীয় সার্বিক সেবা। যা বাড়িয়ে দিচ্ছে নির্যাতনের ঘটনার পুনরাবৃত্তির ঝুঁকি।
সরকারি পর্যায়ে ১০৯ ও ৯৯৯ হেল্পলাইন নম্বর ২৪ ঘণ্টা খোলা থাকার পরও সেবা প্রাপ্তির বিষয়টি প্রশ্নবিদ্ধ। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অভিযোগ আছে কল না ধরার। আর ধরলেও তা ফলপ্রসূ হচ্ছে কী?
নারী ও শিশুর প্রতি নির্যাতনের ঘটনা মনিটরিং ও রিপোর্টং এবং প্রয়োজনীয় আইনত ও মনোসামাজিক সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করছে ব্র্যাক। পাশাপাশি খাদ্য, নগদ অর্থ, স্বাস্থ্য ও প্রয়োজনীয় তথ্য সেবাসহ সচেতনতা ও প্রচারণামূলক কার্যক্রম তো চলছেই। মাঠপর্যায়ে আমাদের সহকর্মীরা নিরলস কাজ করছেন নানাবিধ ঝুঁকি নিয়ে, কিন্তু চেষ্টার কোনো কমতি না রেখে। দুর্যোগ মোকাবিলায় সরকারের সঙ্গে ব্র্যাক একযোগে কাজ করছে ।
জেন্ডার প্রেক্ষিত বিবেচনা করে বিভিন্ন কর্মসূচির ক্ষেত্রে নারীদের বিশেষ করে প্রতিবন্ধী, গর্ভবতী, আদিবাসী, হিজরা সম্প্রদায়ের অন্তর্গত, বয়স্ক, পরিবারে একমাত্র উপার্জনক্ষম, হাওর ও চরাঞ্চলের বাসিন্দা এবং সহিংসতার শিকার নারীদের প্রাধান্য দেয়া হয়েছে। তারপরও বিভিন্ন জরিপ বা মূল্যায়ন ও সংবাদপত্রের প্রতিবেদনে প্রকাশিত হচ্ছে নানা নির্যাতন, সহিংসতা ও বৈষম্যের চিত্র। বর্তমান এই পরিস্থিতিতে কেন পুরুষকর্তৃক নির্যাতন বাড়ছে তার একটি মনস্তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা বা যুক্তি দেওয়া হচ্ছে। গৃহবন্দি থাকার কারণে পুরুষদের মধ্যে যারা নির্যাতনপ্রবণ তাদের সঠিকভাবে আবেগ নিয়ন্ত্রণ করার ক্ষমতা নেই। অনেকেই মনে করেন, আত্মোপলব্ধির জন্য তাদেরও একধরনের মনোসামাজিক সহায়তা দেয়া প্রয়োজন।
এই লকডাউন পরিস্থিতিতে অস্বাভাবিক হারে সহিংসতার ঘটনা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে বিভিন্ন পর্যবেক্ষণ ও গবেষণা প্রতিবেদনে প্রকাশিত হয়েছে। মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের একটি গবেষণা প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, গত এপ্রিল-মে মাসে ৪২৪৯ জন নারী ও শিশু সহিংসতার শিকার হয়েছে। ইউএন উইমেন-এর মানবিক বিপর্যয়ে জেন্ডার বিশ্লেষণমূলক প্রতিবেদনে দেখা গেছে, গৃহস্থালি কাজ, নারীর কাজের বোঝা, নারী নির্যাতন, নারীর স্বাস্থ্য ও পুষ্টির মান, মানসিক স্বাস্থ্যের ঝুঁকিসহ অন্যান্য বৈষম্যমুলক আচরণের বিষয়গুলোকে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে।
নারীর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে জাতীয় কর্মপরিকল্পনাতে পুরুষ ও বালকদের সম্পৃক্ত করার কথা স্পষ্টভাবে উল্লেখ থাকলেও বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে তেমন উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ চোখে পড়ে না। আমাদের অবশ্যই উচিত ইতিবাচক বার্তা তৈরি ও শেয়ার করার মাধ্যমে সেগুলো বৃহত্তর পরিসরে ছড়িয়ে দেয়া।
সহমর্মিতা আর সহানুভূতিশীল একজন মানুষ হিসেবে নিজেকে তৈরি করার গুরুত্ব অনুধাবন করা উচিত আমাদের সবার। এছাড়াও পরিবারের একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি হিসেবে কাজগুলো ভাগাভাগি করে নেয়া ও পারিবারিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সমান অংশগ্রহণ এই করোনাকালে নতুন করে ভাবনার সুযোগ দেবে। জেন্ডার সমতা বজায়ের লক্ষ্যে এই পরিস্থিতি ভিন্নভাবে জীবনকে দেখা, কিছু নতুনভাবে করে দেখা এবং নেতিবাচক পরিচিতি বা ইমেজ থেকে বেড়িয়ে আসার সু্বর্ণ সুযোগ হিসেবে বিবেচিত হতে পারে।
ত্রাণ কর্মসুচি ও করোনা প্রতিরোধের পাশাপাশি এখনই সহিংসতা প্রতিরোধেও প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এজন্য এই সময় প্রয়োজন নতুন করে ভাবা এবং কর্মকৌশল নির্ধারণ করা।
সরকার, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানসমূহ, দাতাগোষ্ঠী, বেসরকারি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান, মিডিয়া, যুব সংগঠন, মানবাধিকার ও নারী অধিকার সংগঠনগুলোর সম্মিলিত উদ্যোগই পারবে এই সংকট মোকাবিলায় কাজ করতে। সুনির্দিষ্টভাবে কর্মপরিকল্পনার ক্ষেত্রে কিছু বিষয় বিবেচনা করা শুধুমাত্র নারীর বিষয় নয়, এটা জাতীয় ইস্যু। যেমন:
সামাজিক, অর্থনৈতিক উন্নয়নকে সচল রাখতে জেন্ডার লেন্স থেকে বর্তমান পরিস্থিতির পর্যালোচনা খুবই প্রয়োজন। এই করোনা পরিস্থিতির বাস্তবতার নিরিখে এসডিজি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বিশেষ করে SDG- ৫ ও ১৬ এর জন্য স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা করা প্রয়োজন।
ব্র্যাকের জেন্ডার জাস্টিস এন্ড ডাইভারসিটি কর্মসূচিতে কর্মসূচি প্রধান হিসেবে লেখক কর্মরত আছেন।
সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা
লেখক তার লেখনীতে বর্তমান এই সংকটে নারীর ঝুঁকিসমূহ ও ঝুঁকি/সংকট সমাধানের বিষয়টিও সুন্দরভাবে তুলে ধরেছে।
লেখকের জন্য শুভকামনা!