কৃষকের পাশে
যুব সম্প্রদায়

June 23, 2020

গ্রামের ১৪/১৫ জন সমবয়সি যুবক ঠিক করলেন, জমির ধান কেটে বাসায় তুলে দেবেন তারা। প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে কাস্তে নিয়ে জমায়েত হলেন কৃষক নুরুল ইসলাম ও মোতালেব হোসেনের বাড়ির আঙিনায়। জমি চিনিয়ে দিলেই শুরু হলো ধানকাটার উৎসব, ভীষণ আনন্দ নিয়ে সব ধান কেটে, আঁটি বেঁধে নিয়ে আসলেন কৃষকের বাড়িতে।

নুরুল ইসলাম ও মোতালেব হোসেন দুই বন্ধু এবং প্রতিবেশী। তারা পেশায় কৃষক। ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশাল উপজেলার চিকনা মনোহর গ্রামের বাসিন্দা। নিজের সামান্য জমিতে চাষাবাদের পাশাপাশি অন্যের জমি বর্গাচাষ করে যা আয় হয়, তা দিয়েই সংসার চলে।

বৈশাখ মাস ধান কাটার মৌসুম। এবার খুব ভালো ফসল হওয়ায় ভীষণ খুশি তারা। মনে মনে হিসাব কষে দেখেছেন, জমির মালিকের ভাগের অংশ, কিস্তির টাকা মিটিয়ে যা অবশিষ্ট থাকবে তাতে সারা বছরের ভাত-কাপড়, বাজার-সওদা হয়ে যাবে অনায়াসে। কিন্তু এ আনন্দে পানি ঢেলে দিল কোভিড-১৯ নামের অজানা এক আপদ।

নুরুল ইসলাম আর মোতালেব কোভিড-১৯ কী তা ভালো করে বোঝেন না। ফসলবোনা, সেচ দেওয়া, ঘরে সোনার ফসল তোলার প্রতিই তাদের ধ্যানজ্ঞান। তারা খুব ভালোমতোই জানেন মাঠের কাজ ঠিকভাবে করতে পারলে ফসল ভালো হবে, আর তাতেই সুখ। এবার ফসল ভালো হলো ঠিকই কিন্তু বিপদ অন্য জায়গায়। ধান কাটার জন্য শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছে না। মাঠে ধান পেকে গেছে, কাটার সময় পার হয়ে যাচ্ছে। একা একা আর কত কাটা যায়।

করোনা মহামারির কারণে দূরপাল্লার গাড়ি চলছে না, ফলে ভিন্ন জেলা থেকে আসছে না মৌসুমি শ্রমিক। মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ার উপক্রম। দিশেহারা নুরুল ও মোতালেব। যে মুখে দুমাস আগেও ছিল অফুরন্ত হাসি, সেখানে এখন শুধুই বিষণ্নতা। ভালোভাবে থাকার আশা তো বাদ, এখন ঘরে ফসল তুলতে না পারলে কিস্তির টাকা পরিশোধ করা নিয়েই তো টান পড়বে। আর সারা বছর খাবেনই-বা কী ? কীভাবে সব সমলাবেন?-এই দুশ্চিন্তায় তাদের চোখে ঘুম নেই।

আরও দুজন কৃষক আরোয়ার জাহান পারভেজ (১৯) এবং মোঃ ইউসুফ (২০), তারা নুরুল ও মোতালেবের পাড়ার বাসিন্দা। দুজনেই ব্র্যাকের সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচির নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা প্রতিরোধে পুরুষ ও ছেলেদের সম্পৃক্তকরণ প্রকল্পের যুব কমিটির সদস্য। এলাকার সবার সঙ্গে চলাফেরা আছে, তাই কারও আপদ-বিপদের খবরও ঠিক পৌঁছে যায় তাদের কানে। এই যেমন নুরুল ইসলাম ও মোতালেব হোসেনের বিপদ তারা ঠিকই ধরতে পেরেছেন।

এ খবর জেনে কি আর চুপ করে বসে থাকা যায়? বন্ধুদের সাথে আলাপ করলেন। তাদেরই নিজ গ্রামের ১৪/১৫ জন সমবয়সি যুবক ঠিক করলেন, দুজনের জমির ধানই কেটে বাসায় তুলে দেবেন তারা। গত মে মাসের ৪ তারিখ পারভেজ আর ইউসুফের নেতৃত্বে প্রত্যেকে নিজ নিজ বাড়ি থেকে কাস্তে নিয়ে জমায়েত হলেন কৃষক নুরুল ইসলাম ও মোতালেব হোসেনের বাড়ির আঙিনায়। জমি চিনিয়ে দিলেই শুরু হলো ধানকাটার উৎসব, ভীষণ আনন্দ নিয়ে সব ধান কেটে, আঁটি বেঁধে নিয়ে আসলেন কৃষকের বাড়িতে।

ইউনিয়নে খবর ছড়িয়ে পড়ল, প্রশংসা সবার মুখে মুখে। দরিদ্র প্রান্তিক কৃষক নুরুল ইসলাম ও মোতালেব হোসেনের মুখে খুশির হাসি, চোখে আনন্দের অশ্রু। দুহাত তুলে সৃষ্টিকর্তার নিকট তাদের মঙ্গলের জন্য প্রার্থনা করলেন। এ প্রসঙ্গে একই গ্রামের বাসিন্দা আব্দুল বারেক জানান, করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবে দেশ যখন অচল হয়ে পড়েছে, ধানকাটার শ্রমিকের সংকট দেখা দিয়েছে, তখন দরিদ্র অসহায় কৃষকের পাশে যুবকদের এভাবে এগিয়ে আসাটা সত্যিই প্রশংসা করার মতো কাজ।

যুব কমিটির সদস্য পারভেজ বলেন, “দেশের এ ক্রান্তিলগ্নে অসহায় মানুষের পাশে দাঁড়াতে পেরে আমি গর্বিত। এ কাজ সফলভাবে করতে পেরে আনন্দিত। ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা  জানাতে চাই গোটা দলকে যারা আমার ডাকে সাড়া দিয়ে এগিয়ে এসেছেন। ধন্যবাদ জানাতে চাই ব্র্যাক সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচিকে, কারণ ২০১৬ সালে আমি যুব কমিটির সদস্য হিসেবে সম্পৃক্ত হয়ে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ ও ত্রৈমাসিক সভার মাধ্যমে অনেক কিছু জানতে ও শিখতে পেরেছি। সেখান থেকেই সমাজের মানুষের জন্য কিছু করার প্রেরণা পাই এবং উদ্বুদ্ধ হই।”

 

লেখকদ্বয় ব্র্যাকের সামাজিক উন্নয়ন কর্মসূচিতে কর্মরত আছেন।

সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা

5 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments