কাওসার-রীনারাই এখন বাংলাদেশ

December 17, 2018

সরকার অভিবাসন খাতে নানা ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। তবে অভিবাসন খাতের পরিস্থিতি উত্তরণের বহু পথ বাকি। সবার আগে সোনার হরিণের জন্য অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করে জেনে বুঝে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম ও খরচ কমাতে হবে।

চাঁদপুরের ছেলে কাওসার। পারিবারিক অবস্থা ততোটা ভালো না। কাওসার বিদেশে গিয়ে ভাগ্য ফেরাতে চায়। সৌদি আরবের বিখ্যাত চেইন রেঁস্তোরা হারফিতে ভালো বেতনে কিছু লোক নেবে শুনে আগ্রহী হয় কাওসার। ব্র্যাকের ভাষা শিক্ষা কেন্দ্রে এসে কাজ চালানোর মতো ইংরেজি শিখে নিল। কাওসার এখন বেশ ভালো বেতনে সেখানে চাকুরি করে। তার পাঠানো টাকাই এখন পরিবারের শক্তি। একইভাবে মানিকগঞ্জের মেয়ে রীনার পাঠোনো টাকাতেই চলছে তার সংসার।

কাওসার আর রীনার মতো এক কোটি বাংলাদেশি আছে যারা ভাগ্য ফেরাতে বিদেশে গেছেন। প্রবাসী কল্যাণ ও বৈদেশিক কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের জনশক্তি, কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ ব্যুরোর (বিএমএইটি) তথ্য অনুযায়ী, ১৯৭৬ সাল থেকে ২০১৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত এক কোটি বিশ লাখ মানুষ লোক বিদেশে গেছেন। এর মধ্যে সাড়ে সাত লাখই নারী। এই প্রবাসীরা প্রতি বছর গড়ে ১৪ থেকে ১৫ বিলিয়ন ডলার প্রবাসী আয় আয় আসছে। জিডিপির আট থেকে দশভাগ অর্থ এখন সরাসরি প্রবাসী আয় থেকে। তাদের কারণেই বৈদেশিক মুদ্রার মজুদ (রিজার্ভ) কয়েক বছর আগেই ৩০ বিলিয়ন বা তিন হাজার কোটি ডলার ছাড়িয়েছে।

এই যে জাতীয় অর্থর্নীতিতে বিশাল অবদান সেই তুলনায় প্রবাসীদের প্রাপ্তি বা মর্যাদার জায়গায় এখনো বাংলাদেশ অনেক পিছিয়ে। প্রবাসীদের সাধারণ অভিযোগ, বিদেশে যখন তারা নানা বিপদে পড়ে বা কোন কাজে দূতাবাসে যান প্রায়ই সময়ই তাদের সঙ্গে ভালো আচরণ করা হয় না। দীর্ঘদিন পর দেশে ফিরে বিমানবন্দরেও আছে নানা ভোগান্তি। এক বাক্যে, প্রবাসীরা রাষ্ট্রকে শুধু দিচ্ছেন, পাচ্ছেন না তেমন কিছুই। এমন পরিস্থিতিতেই এ বছর আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসের স্লোগান অভিবাসীর অধিকার-মর্যাদা ও ন্যায়বিচার।

অভিবাসন খাতের লোকজন জানেন, বাংলাদেশ থেকে বিদেশে যেতে যে অভিবাসন খরচ সেটা বিশ্বের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। সরকার প্রত্যেকটা দেশের জন্য নির্ধারিত খরচ বেঁধে দিয়েছে। কিন্তু কাগজে কলমেই সেটা আছে। যারা বিদেশে লোক পাঠায় তারা অনেক সময়েই বহুগুন বেশি টাকা নেন। এর কারণ, বিদেশে যেমন মধ্যসত্ত্বভোগী আছে, দেশেও তেমনি নানা স্তরে দালালদের দৌরাত্ম। ফলে আট থেকে দশলাখ টাকাও লাগে বিদেশে যেতে। এছাড়া পদে পদে আছে ভোগান্তি-হয়রানি।

পাসপোর্ট তৈরি থেকেই এর শুরু। এরপর রিক্রুটিং এজেন্সির দালাল ও প্রতারক এজেন্সি, চাকরির বিষয়ে অসত্য তথ্য, উচ্চমূল্যে ভিসাকেনাবেচা, স্বাস্থ্যপরীক্ষা, সরকারি ছাড়পত্র—সবক্ষেত্রে সীমাহীন যন্ত্রণা। দেশের আকাশ পার হলে শুরু হয় বিরূপ প্রকৃতি, অমানুষিক পরিশ্রম, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে জীবনযাপন, মালিকদের প্রতারণা, নির্যাতনসহ আরও কত কি। এতো ভোগান্তির পরেও মানুষ ছুটছে বিদেশ নামক সোনার হরিণের পেছনে।

একদিকে লোকজন যেমন প্রতিদিন এয়ারপোর্ট ছাড়ছে আরেকদিকে প্রতিদিন আট থেকে দশজন প্রবাসীর লাশও আসছে। কফিনে করে কার্গো গেট দিয়ে অসে বলে অনেকেরই সেটা চোখে পড়ে না। এদের কেউ মারা যাচ্ছেন স্ট্রোকে কেউ বা হার্ট অ্যাটাকে। ওয়েজ আর্নাস কল্যাণ বোর্ডের তথ্য অনুযায়ী, গত এক যুগে এভাবে ৩৬ হাজার প্রবাসীর লাশ এসেছে। এদের অনেকেই ২৮ কিংবা ৩০ বছরেও মারা গেছেন।

বাংলাদেশ থেকে এ পর্যন্ত কত লোক কাজের ভিসায় বিদেশে গেছেন সেই তথ্য সরকারের কাছে থাকলেও কতজন ফেরত এসেছেন সেই তথ্য নেই।  তবে শুধুমাত্র ট্রাভেল পাস নিয়ে প্রতিবছর প্রায় ৫০ হাজার প্রবাসী ফিরে আসেন। গত আট বছরে অন্তত দুই লাখ প্রবাসী ফিরে এসেছেন।

বাংলাদেশের প্রচলিত সমাজ ব্যবস্থায় কেউ বিদেশে যাচ্ছেন শুনলে পরিবার, আত্মীয় স্বজন সবাই খুশি হয়।  তখন তাকে ধার দেওয়ার লোকেরও অভাব হয় না। কিন্তু একই মানুষ যখন ব্যর্থ হয়ে ফিরে আসেন তাকে নেতিবাচকভাবে দেখা হয়।  আবার অনেক বছর বিদেশে থেকে টাকা পয়সা নিয়ে এসেছেন এমন মানুষও দেশে ফিরে কী করবেন বুঝে উঠতে পারেন না।  এসব কারণে বিদেশে যাওয়ার সময় যেমন তার পাশে থাকা জরুরী তেমনি কেউ ফিরে এলেও তার পাশে সবার থাকা জরুরী।

পৃথিবীর সবচেয়ে বড় বেসরকারি সংস্থা ব্র্যাক বিদেশ ফেরতদের পাশে স্বজনের মত হাত বাড়িয়েছে।  তাদের সাথে সমব্যাথী ও প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহন করেছে যাতে ফেরত বিদেশ ফেতরা সমাজের মূল স্রোতে নিজেকে পুনরেকত্রীকরণ করতে পারেন। পাশাপাশি লোকজন যেন দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে পারে সেই কাজটিও করছে ব্র্যাক।

সাম্প্রতিক সময়ে সৌদি আরব ফেরত অসহায় নারীদের কান্না অনেকেই দেখেছেন। তাদের অনেক সময়েই জরুরী চিকিৎসা সহায়তার প্রয়োজন হয়। অনেকের বাড়ি যাওয়ার টাকা থাকে না।  অথচ তাদের পাশে দাঁড়ানোটা খুব জরুরী। একইসঙ্গে নারীদের বিদেশে যাওয়াটাও নিরাপদ ও মর্যাদার করতে হবে।

সরকার অভিবাসন খাতে নানা ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছে। তবে অভিবাসন খাতের পরিস্থিতি উত্তরণের বহু পথ বাকি। সবার আগে সোনার হরিণের জন্য অবৈধভাবে বিদেশে যাওয়া বন্ধ করে জেনে বুঝে দক্ষ হয়ে বিদেশে যেতে হবে। মধ্যসত্ত্বভোগীদের দৌরাত্ম ও খরচ কমাতে হবে। দরকার নতুন শ্রমবাজার, নারীদের সুরক্ষা। তবে রাষ্ট্র-দূতাবাস-স্বজন সবাইকে মনে রাখতে হবে প্রবাসীরা শুধু টাকা পাঠোনোর যন্ত্র নয়। তারা মানুষও। কাজেই সবসময় তাদের মানবিক মর্যাদা দিতে হবে। আর সে কারণেই ‘অভিবাসীর অধিকার-মর্যাদা ও ন্যায় বিচার’- এই প্রতিপাদ্যটি যথাপযুক্ত।

আমরা চাই মানুষ হিসেবে সকল অভিবাসীর মর্যাদা ও সম্মান সমুন্নত থাকুক। তবে সেটি শুধু বছরের একটি দিন নয়, সারাবছর। ১৮ ডিসেম্বরকে সামনে রেখে স্যালুট এক কোটিরও বেশি প্রবাসীকে যারা দেশের অর্থনীতি সচল রাখার পাশাপাশি অনেক দূর থেকেও বুকের মধ্যে যত্ন করে রেখেছেন লাল সবুজের জন্য ভালোবাসা। বিজয়ের মাসে ও আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবসে তাদের সবাইকে শুভেচ্ছা। যতো দূরেই থাকেন আপনারাই বাংলাদেশ।

শরিফুল ইসলাম হাসান, ব্র্যকের অভিবাসন কর্মসূচির প্রধান

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments