‘নিয়ম মেনে চলতে হবে, মনোবল ঠিক রাখতে হবে’

May 12, 2020

১৬ তারিখ নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে আমার করোনা ‘পজিটিভ’ বলে জানানো হলো। পরদিন আমি ব্র্যাকের ডাক্তার ও আইইডিসিআর কর্তৃপক্ষের পরামর্শে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হলাম। সেখানে আইসোলেশন ইউনিটে আমার চিকিৎসা শুরু হলো। এরপর দুবার আমার শরীর থেকে নমুনা নিয়ে ল্যাবে পরীক্ষার করার পর ফল নেগেটিভ এলো। গত ২৯শে এপ্রিল আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

ব্র্যাকের একজন কর্মী ফরিদ হোসেন (কর্মীর ছদ্মনাম)। বয়স ৩৭। স্ত্রী, সন্তান, শ্বশুর, শাশুড়িসহ ঢাকাতেই বসবাস করেন। করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে কুর্মিটোলা জেনারেল হাপাতালে চিকিৎসাধীন ছিলেন। ১৩ দিন পর সুস্থ হয়ে বাসায় ফিরেছেন। করোনায় তার আক্রান্ত হওয়া, হাসপাতালে থাকা এবং সুস্থ হয়ে বাসায় ফেরার অভিজ্ঞতা জানিয়েছেন তিনি।

কীভাবে আমি আক্রান্ত হলাম? 

করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে অফিস বন্ধ হওয়ার পর থেকে আমি বাসাতেই থাকতাম। ঘরে বসেই অফিসের কাজ করতাম। মাঝে মাঝে অসুস্থ শ্বশুর-শাশুড়ির জন্য ওষুধ কিনতে নিচে নামতে হয়েছে। এছাড়া মাঝেমধ্যে বাসার পাশে ভ্যান থেকে সবজি কিনতে গিয়েছি। এর বাইরে বাসা থেকে বের হইনি। বাসার অন্য সদস্যরাও বাইরে যাননি। আমার যেটুকু মনে হয়, ওষুধের দোকান কিংবা সবজিওয়ালার কাছ থেকেই আমার সংক্রমণ হয়েছে।

লক্ষণ কী ছিল?

এপ্রিলের ৮ তারিখে আমি হালকা জ্বর অনুভব করি। একদিন পর শরীরে ব্যথা শুরু হলো। তখন ব্র্যাকের ডাক্তারের কাছে ফোন দিলাম। ডাক্তার আমাকে নাপাজাতীয় ওষুধ খেতে বললেন। কয়েকদিন পরও জ্বর না কমায় আমি একটি দৈনিক পত্রিকা থেকে পাওয়া আইইডিসিআর-এর ইমেইলে আমার অবস্থা বর্ণনা করে লিখলাম। মেইল পাঠানোর দুদিন পর সেখান থেকে আমার বাসার ঠিকানা জানতে চাওয়া হলো। ১৪ই এপ্রিল আইইডিসিআর থেকে একটি টিম বাসায় এসে করোনা পরীক্ষার জন্য নমুনা সংগ্রহ করে নিয়ে গেল।

হাসপাতালের অভিজ্ঞতা

১৬ তারিখ নমুনা পরীক্ষার ফলাফলে আমার করোনা ‘পজিটিভ’ বলে জানানো হলো। পরদিন আমি ব্র্যাকের ডাক্তার ও আইইডিসিআর কর্তৃপক্ষের পরামর্শে কুর্মিটোলা জেনারেল হাসপাতালে ভর্তি হলাম। সেখানে আইসোলেশন ইউনিটে আমার চিকিৎসা শুরু হলো। এরপর দুবার আমার শরীর থেকে নমুনা নিয়ে ল্যাবে পরীক্ষার করার পর ফল নেগেটিভ এলো। গত ২৯শে এপ্রিল আমাকে হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র দেওয়া হয়েছে।

হাসপাতালে গিয়ে প্রথম দুইদিন খুবই খারাপ লেগেছিল। আমি বাসা থেকে একটি ইলেকট্রিক কেটলি ও ফ্লাস্ক নিয়ে গিয়েছিলাম। দুই-তিন ঘণ্টা পর পর গরম পানির ভাপ নিতাম আর আদা-লবঙ্গ মিশিয়ে গরম পানি খেতাম। হাসপাতাল থেকে সকালে দুধ, ডিম আর পাউরুটি দেওয়া হতো। দুপুর আর রাতে দেওয়া হতো ভাত, মুরগির মাংস আর সবজি।

হাসপাতালের ভেতরে কাউকে আসতে দিত না। আমার বাসার লোকেরা দুদিন এসে হাসপাতালের গেটে আমার জন্য ফল ও শুকনো খাবার পৌঁছে দিয়ে গেছে। ডাক্তাররা দিনে একবার এসে দূর থেকে রোগীর সঙ্গে কথা বলতেন। নার্সরা দিনে দুইবার কেমন আছেন জিজ্ঞেস করে একটি খামে ঔষধ দিয়ে যেতেন। ঔষধ বলতে সিভিট আর জিংক ট্যাবলেট।

হাসপাতালে সারাক্ষণ মাস্ক পরে থাকতাম। রোগীদের সঙ্গে কথা বলতাম। একটা জিনিস দেখেছি, করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর রোগীরা যতটা সচেতন, আক্রান্ত হওয়ার আগে তারা ততটা ছিলেন না। অনেকেই বাজারে গেছেন, মসজিদে গেছেন মাস্ক ব্যবহার না করেই। অনেকে সামাজিক দূরত্বও মানেননি। তবে আক্রান্ত হওয়ার পর সবাই এসব ব্যাপারে সচেতন হয়েছেন। টেলিফোনে আত্মীয়-স্বজনদের নিয়ম মানার কথা মনে করিয়ে দিচ্ছেন।

হাসপাতালে রোগীদের জন্য সাহায্য আরো অনেক বাড়ানো দরকার। শ্বাসকষ্টের রোগীদেরও অক্সিজেন সিলিন্ডার নিজেদেরকেই বহন করে আনতে হতো।

অন্যদের জন্য আমার পরামর্শ

‘বাসায় ফিরে আসার পর আমার খুব ভালো লাগছে। করোনা নিয়ে যত ভয় ছিল, তা নিজের মনোবল ও চিকিৎসকদের পরামর্শমতো চলে জয় করেছি।’

আমার চরম দুঃসময়ে আমাকে মানসিকভাবে সাহস এবং শক্তি জুগিয়েছেন ব্র্যাকের ডাক্তাররা। তাঁরা নিয়মিত আমার খোঁজ-খবর নিয়েছেন। আমি তাদের কাছে কৃতজ্ঞ। আমি সবাইকে বলব: আপনারা সব সময় সাবধানে থাকবেন। মাস্ক ব্যবহার করবেন। শারীরিক দূরত্ব বজায় রেখে চলবেন। কখন কোথায় কার মাধ্যমে এই ভাইরাসটি শরীরে প্রবেশ করবে তা কেউ জানে না। আর হ্যাঁ স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলবেন।

আর যদি কেউ আক্রান্ত হন, তাদের উদ্দেশ্যে বলব, সাহস রাখুন। ধৈর্য ধরুন। মনোবল ঠিক রেখে নিয়ম মেনে চলতে পারলে করোনা থেকে আরোগ্য লাভ করা সম্ভব। কেবল শ্বাসকষ্ট হলেই হাসপাতালে যাওয়া উচিত। না হলে সবার নিজের ঘরে আইসোলেশনে থেকেই চিকিৎসা নেওয়া ভালো।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments