একুশ আমার শিকড়, একুশই অধিকার

February 20, 2018

“ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়..
..ওরা আমার মায়ের ভাষা কাইড়া নিতে চায়..”

কত আক্রোশ মনে জমে থাকলে, কত বড় অন্যায়-জুলুমের মুখোমুখি হলে এমন কথা ভাবা যায়, লেখা যায়! কোন ভাষায় লিখছি তা কিন্তু মুখ্য নয়, মায়ের থেকে শেখা ভাষা যখন আমার মুখ থেকে শাসকগোষ্ঠী কেড়ে নিতে চায় তখন তা আমার বেঁচে থাকার ‘মৌলিকতম’ অধিকারের উপরই হাত দেওয়া। আমাদের ভাষার ক্ষেত্রেই এটা ঘটেছে। বাঙালি কেন মেনে নেবে এমনটা? যে কারও ভাষার ক্ষেত্রে এমনটা হতেই পারত, হয়তো দেশ বা প্রতিবাদের ধরন হতো ভিন্ন।

ক্ষণিকের বিপদে যে শিশুটি মা বলে চিৎকার করে মমতাময়ী মাকে আঁকড়ে ধরে, সে কীভাবে মায়ের শেখানো ভাষার ওপর নিষেধাজ্ঞা মেনে নেবে?

সেদিন বাঙালি সেটা হতে দেয়নি। একাট্টা হলো পুরো জাতি নিজেদের মাতৃভাষার প্রতি শাসকগোষ্ঠীর আক্রোশ মোকাবেলা করতে।

এলো বায়ান্ন। ঝড় আসছে। চারপাশে সবাই শুনতে পাচ্ছে সেই ঝড়ের আগমনি বার্তা। সেই ঝড়ের উত্তাল স্রোত ভিজিয়েছে প্রতিটি বাঙালিকে। সবার দাবি একটাই-

‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই..’

এলো একুশ। এলো শাসকগোষ্ঠীর জন্য এক মহাপ্রলয়। বাংলার ছাত্রসমাজ রাজপথে নেমে এলো মাতৃভাষার দাবিতে। তারা ভঙ্গ করল ১৪৪ ধারা। বাংলাভাষাকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার দাবিতে একের পর এক ব্যারিকেড ভেঙে এগিয়ে চলল বাঙালি জাতির প্রতিনিধিত্ব করা এক ঝাঁক তরুণ। এক দফা এক দাবি, বাংলা দিয়ে তবে যাবি।

এই বাংলার প্রতিটি মুখে অ, আ, ক, খ অক্ষরগুলো নিজেদের রক্তের একেক ফোঁটা দিয়ে চিরস্থায়ী করে গেলেন

সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার প্রমুখ। দেশপ্রেমের এই উর্বর মাতৃভূমিতে বপন করা বাংলাভাষার সেই বীজ পরবর্তীকালে এই বাঙালি জাতিকে এনে দিল স্বাধীনতা, নিজেদের লালসবুজ পতাকা। এই পতাকা আমার, আমার মায়ের, আমার সন্তানের।

উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা ঘোষণার অর্থ ছিল বাংলাকে দমিয়ে রাখা। বাংলা তখন প্রতিবাদের ভাষা, বাংলায় রচিত হচ্ছে শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে গান, কবিতা, নাটক। ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তির বিরুদ্ধে বাঙালি যেমন ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, এবারও তাই হলো। অধিকার আদায়ে রচিত হতে লাগলো অবিশ্বাস্য রকমের শক্তিশালী সব গল্প ও কবিতা। সাহিত্য এবং গভীরতার বিচারে প্রতিটি রচনাই যেন কালজয়ী চেতনায় আঁকা সাহসী বাঙালির প্রতিচ্ছবি।

রক্ত ঝরল। বাঙালি দমল না। বাংলার মাটিতে প্রতিষ্ঠিত হলো বাংলা ভাষার পূর্ণ অধিকার। সেই অধিকারে আরও অনেক বৈষম্য যেন বাঙালি অনুধাবন করতে পারল। শুরু হলো স্বাধীনতা সংগ্রাম। এক সাগর এ রক্তের বিনিময়ে এলো স্বাধীনতা, বাঙালি পেল নিজের পরিচয়।

বাঙালি জাতিসত্তার মূলে আছে ভাষা। ভাষার অস্তিত্ব একটি জাতির শিকড়ের মতো। ভাষা মানে মুখনিঃসৃত কিছু শব্দের ব্যবহারই কেবল নয়, তা নির্জন সাগর থেকে চোখে পড়া দূরের এক বাতিঘরের মতো। বাতিঘর যেমন আলো ছড়িয়ে পথ দেখায় হারিয়ে যাওয়া নাবিককে, ভাষা তেমনি নির্দিষ্ট করে দেয় একটি জাতির পথ।

ভাষা এগিয়ে চলে তার নিজস্ব গতিতে। এ যেন এক বিশাল সাগর। তার স্রোত নিয়ে কখনও সে পৌঁছে যায় কোন নতুন তীরে, আবার প্রবল গর্জনে সে কখনও পাঠিয়ে দেয় আগামবার্তা।

উর্দু ছাড়া বাংলা ভাষাকে কেউ সরাসরি আক্রমণ করেনি সত্য, তবে ভাষাচর্চার দিক থেকে জাতি হিসেবে যে আমরা খুবই সুপরিচিত তাও কিন্তু নয়। গাছের গোড়ায় নিয়মিত পানি দিলে যেমন গাছের বৃদ্ধি নিশ্চিত হয়, তেমনি ভাষার নিয়মমাফিক, নির্ভুল চর্চা নিশ্চিত করে দেয় তার বিকাশ।  একটু যদি আমাদের আশেপাশে তাকাই, তাহলে আমাদের মনে হয়তো প্রশ্ন জাগতে পারে আসলেই কি ভাষার যথাযথ চর্চা আমরা করছি? নিজেদের মধ্যে যখন শিক্ষা বা কর্মক্ষেত্রে ভাব বিনিময় করি, মাতৃভাষা কি সেখানে আসলেই প্রাধান্য পাচ্ছে?

সময়ের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের অভ্যাস বদলায়, বদলায় রুচি। এই পরিবর্তনের স্রোতে কোথায় যেন অদৃশ্য চোরাবালির মধ্যে বাংলা ভাষার চর্চা হারিয়ে যেতে বসে, কিন্তু পরক্ষণেই আমাদের টনক নড়ে। একুশে বইমেলাসহ আরও বিভিন্ন জাতীয় কার্যক্রমের মাধ্যমে বাংলা চর্চার আনুষ্ঠানিক প্রয়াস নেওয়া হয় ঠিকই, কিন্তু ব্যবহারের সময় কিন্তু বিদেশি ভাষা মুখে আসছে বেশি, মায়ের ভাষার আধিপত্য হয়তো সেখানে থাকে না। তাই আনুষ্ঠানিক বা পোশাকি রূপে নয়, মাতৃভাষার প্রতি থাকতে হবে প্রাণের তাগিদ। একদিন সবার জন্য বাসযোগ্য যে সুন্দর পৃথিবী নির্মাণের স্বপ্ন আমরা দেখি, সেখানে সকল মাতৃভাষা পাবে সমান প্রাধান্য, এই আমাদের কামনা।

Comments are closed.