দেশে পাঁচ বছর চাকরি করার পর রাফিজা টাকা জমিয়ে ওমানের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতে যান। বিদেশে যাবার আগে তিনি ছেলেকে রেখে যান মায়ের কাছে। আট বছর পর দেশে ফিরে আসেন। ছেলে বড়ো হয়েছে, তাকে এবার ব্যাবসা করার ব্যবস্থা করে দেন। নিজে সেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত হবার সিদ্ধান্ত নেন।
খুব অল্প বয়সে, পঞ্চম শ্রেণিতে পড়ার সময়ই তার বিয়ে হয়ে যায়। সেসময় বিয়েকে তিনি ভেবে নিয়েছিলেন বেঁচে থাকার নতুন স্বপ্ন, নতুন জীবন। কিন্তু তার স্বপ্ন, দুঃস্বপ্ন হতে সময় নেয়নি।
বলছি মেহেরপুর জেলার গাংনী উপজেলার হিজলবাড়িয়া গ্রামের বাসিন্দা রাফিজা বেগম।
বেকার স্বামী; তাই সংসারে অভাব-অনটন এত বেশি ছিল যে ঝগড়াবিবাদ লেগেই থাকত। স্বামীর জন্য সহজ সমাধান ছিল যৌতুক চাওয়া। সেই পথটিকেই সে বেছে নিয়েছিল। বাবার বাড়ি থেকে টাকা আনতে বলত, চাপে রাখার জন্য নির্যাতন করত। এসব সহ্য করতে না পেরে একমাত্র ছেলেকে নিয়ে রাফিজা বাবার বাড়ি চলে আসেন এবং স্বামীকে তালাক দেন। শুধুশুধুই ঝামেলা বাড়ানোর জন্য স্বামী নিজের শরীরে আঘাত করে থানায় রাফিজার বিরুদ্ধে মিথ্যে অভিযোগ করে।
এ পর্যন্ত গল্পটা এমন, যার মুখোমুখি হয়তো হয়েছেন আমাদের দেশের অনেক নির্যাতিত নারী।
রাফিজার গল্প এখানেই শেষ হতে পারত, কিন্তু তা হয়নি। এরপর তিনি অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে দায়ের করা মিথ্যে অভিযোগ মিটমাট করেছিলেন। তবে মনের কষ্টেই বলুন আর সামাজিকভাবে হেয় হবার কারণেই বলুন; এ ঘটনার পর তিনি গ্রাম ছেড়ে ঢাকায় চলে আসেন। চাকরি নেন একটি গার্মেন্টসে।
দেশে পাঁচ বছর চাকরি করার পর রাফিজা টাকা জমিয়ে ওমানের একটি গার্মেন্টসে চাকরি করতে যান। বিদেশে যাবার আগে তিনি ছেলেকে রেখে যান মায়ের কাছে। আট বছর পর দেশে ফিরে আসেন। ছেলে বড়ো হয়েছে, তাকে এবার ব্যাবসা করার ব্যবস্থা করে দেন। নিজে সেবামূলক কাজের সাথে যুক্ত হবার সিদ্ধান্ত নেন।
ব্র্যাকে স্বাস্থ্যসেবিকার কাজের পাশাপাশি লেখাপড়াও শুরু করেন। উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এসএসসি এবং এইচএসসি পাশ করেন। এরপর কুষ্টিয়া হোমিওপ্যাথিক মেডিকেল কলেজ ও হাসপাতাল থেকে BHMS প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেন। শুরু হয় জীবনের আরেক অধ্যায়। নিজের বাড়িতে হোমিও ডাক্তারির চেম্বার দিয়েছেন। গ্রামের দরিদ্র সাধারণ মানুষরা সেখানে ফ্রি চিকিৎসা পায়।
রাফিজার নেতৃত্বে হিজলবাড়িয়া পল্লীসমাজ যুব উন্নয়ন অধিদপ্তর থেকে রেজিস্ট্রেশন লাভ করেছে। ব্র্যাকের পল্লীসমাজের সদস্যরা দরিদ্র মানুষের অধিকার রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এলাকার অসহায় নারীদের কল্যাণে নিরলস কাজ করতে তিনি পল্লীসমাজের প্ল্যাটফর্মকেই বেছে নিয়েছেন।
কোভিড-১৯ এর কারণে যাদের আর্থিক অবস্থা ভালো চলছে না, নিজ এলাকার এমন ২০ জন নারীকে গত ঈদে জামা-কাপড় ও নগদ টাকা দিয়ে সহায়তা করেছেন। এলাকার মানুষের কাছে রাফিজা আপা একজন ভালো মনের মানুষ, যিনি বিপদ-আপদে পাশে থাকেন। সবাই জানে রাফিজা আপার কাছে গেলে কেউ খালি হাতে আসে না, কিছু না-কিছু দিয়ে তিনি সাহায্য করবেন।
যে মানুষটির নিজের পায়ের তলায় একদিন মাটি ছিল না; সেই মানুষটিই জীবনযুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়ে মানুষের জন্য এখন কাজ করে যাচ্ছেন। স্যালুট জানাই মানবদরদি রাফিজা বেগমকে।
লেখক ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচিতে কর্মরত আছেন।
সম্পাদনা- সুহৃদ স্বাগত, তাজনীন সুলতানা
বাহ্! জেনে মন ভরে গেলো। ‘রাফিজা বেগম’ অনুুপ্রেরণার অপর নাম।