এই নিষ্ঠুরতার শেষ কোথায়?

November 24, 2020

এই ঘটনাগুলো শুধু ‘গল্প’ নয়, বাস্তব। যে বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে শিউলি স্তম্ভিত, ভীত এবং স্বপ্নহারা। যে বাস্তব একজন নারীর সারা জীবনের ক্ষত হয়ে বুকে জমে থাকে! যে বাস্তব থেকে জন্ম নেয়া প্রবল ভয় জীবনের সারল্য কেড়ে নেয়। রাতদিন যা তাকে তাড়া করে ফেরে।

২০১৮ সাল। রাত তখন প্রায় ৮টা। গ্রামের অনেকে তখন ঘুমোতে গেছে। শিউলির (ছদ্মনাম) মা বাড়িতে ছিলেন না, নিজেদের একচালা টিনের ঘরে ঘুমিয়ে আছে ছোটো ভাইবোনেরা। এমন সময় বাইরে থেকে প্রথমে হালকা শিস দেওয়ার আওয়াজ শোনা যায়। নির্জন গ্রাম, ঘরে মা নেই। তবে ১৬ বছর বয়সি শিউলির কাছে এ নতুন কিছু নয়।

২০১২ সালে বাবা মারা যাওয়ার পর থেকে তাদের দুর্বল ভেবে গ্রামের অনেকে সুযোগ নিতে চাইতো। নানা অজুহাতে মাকে বাড়ি ছাড়ার হুমকি দিত। এমনকি বিবাহিত বড়ো বোন বাড়িতে বেড়াতে আসার পর একবার তো তাকেও ছাড়েনি তারা। ঝগড়ার এক পর্যায়ে তার গায়ে হাত তোলে।

শিউলির সাথে দেখা করতে যাওয়ার আগে আমার মধ্যে এক ধরনের অস্থিরতা আর বিষণ্নতা কাজ করছিল। তার সাথে দেখা হবার পর, মনে হলো আমরা কতটা নির্লিপ্ত থাকি, কত দীর্ঘশ্বাসের দায় উপেক্ষা করে ভালো থাকার অভিনয় করি।

এই দুর্ভাগ্যের গল্পে কয়েকটি ভালো চরিত্র আছে। শিউলির ৫ ভাইবোন, তার মা এবং এই পরিবারের বিপদের সময়ে তাদের পাশে দাঁড়ানো আরও কয়েকজন।

শ্রীমঙ্গল থেকে গাড়িতে মৌলভীবাজারের নওয়াগাঁও যাবার পথে ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির (সিইপি) জেলা ব্যবস্থাপক তারেক ভাইয়ের সাথে কথা হচ্ছিল। ঐ গ্রামেই শিউলির বাড়ি। তারেক ভাই আলাপ করছিলেন কী ধরনের কাজ করেন, কাদের সঙ্গে করছেন-এসব নিয়ে।

তারেক ভাইয়ের আলাপে বারবার ঘুরেফিরে আসছিল গ্রামগঞ্জ, থানা-উপজেলা, মফস্সল শহরে প্রতিনিয়ত ঘটে যাওয়া নারীর প্রতি ঘৃণ্য অপরাধের কথা। ধর্ষণ, প্রেম নিবেদনে হুমকি, অশালীন মন্তব্য, খেলাধুলো বা শিক্ষামূলক কোনো কাজে অংশগ্রহণ থেকে বিরত থাকতে বাধ্য করা- এরকম নানা অপরাধ। এই ধরনের গল্পগুলোর মধ্যে একটি মিল হলো-এগুলো বেশির ভাগ সময় খুঁজে খুঁজে বের করতে হয়। এসব ঘটনার প্রতিবাদে সমাজে আলোচনা হয় কম। অপরাধীর দাপটে ভুক্তভোগী এবং তার পরিবার থাকে কোণঠাসা। তাই আড়ালে নির্যাতনের জ্বলন্ত অভিশাপে ঝরে যেতে থাকে নিরপরাধ, অসহায় এবং হতভাগ্য অগণিত নারী এবং শিশুর প্রাণ।

গল্পগুলো আচমকা এসে ধরা দেয়। যেমনটি ঘটেছে শিউলির ক্ষেত্রে। বড়ো রাস্তার পাশে যাত্রীর খোঁজে দাঁড়িয়ে থাকা সিএনজি ড্রাইভারদের কানে শিউলির আর্তচিৎকার না পৌঁছলে, আজ একজন শিউলি বেঁচে আছেন কিনা তার খোঁজও কেউ রাখত না।

বারবার বলছি ‘গল্প’, কিন্তু আসলে কি তাই? এই ঘটনাগুলো বাস্তব। যে বাস্তবের মুখোমুখি হয়ে শিউলি স্তম্ভিত, ভীত এবং স্বপ্নহারা। যে বাস্তব একজন নারীর সারা জীবনের ক্ষত হয়ে বুকে জমে থাকে! যে বাস্তব থেকে জন্ম নেয়া প্রবল ভয় জীবনের সারল্য কেড়ে নেয়। রাতদিন যা তাকে তাড়া করে ফেরে।

ফিরে যাই সেই রাতে। ৮টা বেজেছে কী বাজেনি, শিউলি ঘরের দরজায় কড়া নাড়ার আওয়াজ। আগুপিছু না ভেবেই সেদিন দরজা খুলে দিয়েছিলেন শিউলি। সাথে সাথে তাকে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে প্রায় ৭-৮ জন মিলে জোর করে বাইরে নিয়ে আসে। একটি সিএনজি দাঁড়ানো ছিল। অন্য দু-তিন জন তাকে জোর করে উঠিয়ে নিয়ে যায়।

“আমরা পরে শুনছি রাস্তার পাশের একটা ঘর থেকে চিৎকার ভেসে আসতেছিল। শুইন্যা আশেপাশের লোক গিয়া দেখে এই ঘটনা।” বলছিলেন পঞ্চাশোর্ধ মোহাম্মদ শহীদুর রহমান, তিনি ঐ এলাকার ব্র্যাকের সিইপি পরিচালিত পল্লীসমাজের নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধ কমিটির একজন সদস্য।

আমরা তার পাশে আছি এবং অপরাধ বন্ধের উদ্দেশ্যেই তার দুঃসহ অভিজ্ঞতা সম্পর্কে জানতে চাইছি, এ বিষয়ে পুরোপুরি আশ্বস্ত ছিলেন শিউলি। তবু সেই রাতের ঘটনা বর্ণনা করতে গিয়ে তিনি বারবার থমকে যাচ্ছিলেন, তাই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা শহীদুর ভাই নিজে থেকে কথা বলতে এগিয়ে আসেন। তার বর্ণনায় আমরা জানতে পারি আরও অনেক কিছু।

মোহাম্মদ শহীদুর রহমান

ধর্ষক আলামিন তাকে প্রায় দুই বছর ধরে উত্যক্ত করত। স্কুলে যাওয়া-আসার পথে বা বাড়ির বাইরে এসে তাকে প্রায়ই আপত্তিকর কথাবার্তা বলত, কু-প্রস্তাব দিত। শিউলির গ্রাম থেকে যথেষ্ট দূরে বাস করার পরও আলামিনের অপরাধ স্পৃহা তখন চরম আকার ধারণ করেছে। সবরকম খোঁজখবর রাখছিল, সুযোগ পেয়ে সেদিন রাতে শিউলিকে নিজ বাড়ি থেকে তুলে নিয়ে যায়।

শিউলিকে অপহরণ করার পর সিএনজি অটোরিকশা চলছিল সদরের দিকে। রাস্তার পাশের একটি ফাঁকা ঘরে তাকে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে আলামিন প্রায় ১ ঘণ্টা নির্যাতন চালায়। এক পর্যায়ে সেখান থেকেই শিউলিকে উদ্ধার করেন ঘটনাস্থলে উপস্থিত স্থানীয় কয়েকজন। উদ্ধারের পর শিউলিকে হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু প্রাথমিক চিকিৎসার পর এলাকার চেয়ারম্যানের বাড়িতে তাকে নিরাপদ আশ্রয়ে রাখা হয়। আলামিনকে আটকে রাখা হয়। সকালে খবর পেয়েই চেয়ারম্যানের বাড়িতে গিয়েছিলেন শহীদুর ভাই।

শহীদুর ভাইয়ের কথায় জানা যায়, সকালবেলা চেয়ারম্যানের বাড়িতে সালিশ বসে। সেখানে আলামিনের বাবাও আসে। তারা বেশ প্রভাবশালী ও সচ্ছল ধনী পরিবার। শিউলির পারিবারিক প্রেক্ষাপট, ঘটনার কথা জানাজানি হয়ে ভবিষ্যতে তার আরও ক্ষতি হবার আশঙ্কায় এবং এই অপরাধের প্রতিবাদে সালিশে উপস্থিত থাকা এলাকার অনেকেই আলামিনের শাস্তির দাবি তোলেন।

আমাদের দেশে অপরাধের শিকার হওয়াও যেন একটি অপরাধ।

আলামিনের সঙ্গে শিউলির বিয়ের প্রস্তাব দেওয়া হয়। আলামিন প্রথমে চাপে পড়ে রাজি হলেও কিছুক্ষণ পরই সে মত বদলায়। কোনোভাবেই বিয়েতে তাকে আর রাজি করানো যায় না।

শহীদুর ভাই শিউলির এই দুর্যোগময় পরিস্থিতিতে তার পাশে থাকার সিদ্ধান্ত নেন। ধর্ষণ অপরাধ, আর সেই অপরাধের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করতে তিনি প্রথমে থানায় যান, এমনকি তিনি যৌন হয়রানি বিষয়ক হেল্প লাইন ১০৯-এ ফোন করেন । ফোনে পুরো বিষয় বলার পর মন্ত্রণালয় থেকে জানানোর পর মৌলভীবাজার সদর থানার ওসির সঙ্গেও যোগাযোগ করা হয়। পুলিশ মামলা গ্রহণ করে।

শহীদুর ভাই এককালে খেলাধুলো করতেন, বয়সের কারণে আজ তা থেমে গেছে। কিন্তু তার সোচ্চার মানসিকতা থেমে যায়নি। একজন সচেতন সমাজকর্মী হিসেবে শিউলির ভবিষ্যতের নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে প্রশাসনের কাছে সহায়তা চেয়ে আইনি পদক্ষেপে সহায়তার পাশাপাশি এসপি, ইউএনও সবার অফিসে নিজেই টানা তিন দিন অবিরাম ছুটেছেন।

আলামিনকে গ্রেফতার করা হয়। কিন্তু আইনের মারপ্যাঁচে সে জামিন পেয়ে যায়। এরপর থেকে আর সে শিউলির এলাকায় আসে না। স্থানীয় প্রশাসনের সহায়তায় ঘটনার এক বছরের মাথায়, অর্থাৎ ২০১৯ সালে প্রায় আড়াই লাখ টাকা অনুদানে শিউলিদের বাড়ি নতুন করে নির্মাণ করে দেওয়া হয়।

বাবার মৃত্যুর পর থেকে আজ পর্যন্ত প্রতিটি দিনই কোনো-না-কোনো হুমকি বা ভয়ভীতি প্রদর্শন করা হয় এই পরিবারের কাউকে না কাউকে। উদ্দেশ্য, জমি দখল বা অবৈধ যেকোনো সুবিধা আদায়। এমনকি আমরা যেদিন শিউলির সাথে দেখা করি, তার আগের দিন রাতেও তাদের নতুন টিনের চালে স্থানীয় কেউ রাতের বেলা ঢিল মেরে ভয় দেখিয়েছে।

শিউলির মা সখিনা বেগম (ছদ্মনাম) জীবনযুদ্ধে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত এবং নিঃসঙ্গ। মা যখন কাজে বেরিয়ে যান, তখন শিউলিকেই ভাইবোনদের দেখভাল করতে হয়। এজন্য ক্লাস এইটের পর আর তার পড়াশোনাও হয়নি। আর পরিবারের এই নিদারুণ অভাব তার স্বপ্ন দেখার সাহসটুকুও কেড়ে নিয়েছে। তিনি শুধু চান, কোনোরকমে যেন তারা নিরাপদে একটু খেয়ে-পরে দিনাতিপাত করতে পারে। এখনও তার স্কুলে যাওয়ার ইচ্ছে আছে। কিন্তু সাহস নেই, উপায়ও নেই।

ঘরের বাইরে শিউলির পাশে বসে মাথা নিচু করে শহীদুর ভাইয়ের কথা শুনছিলেন রাশেদা বেগম। তিনি সিইপি পরিচালিত মৌলভীবাজার জেলা যৌন হয়রানি নির্মূল কমিটির আহবায়ক। পেশায় মৌলভীবাজারের একটি স্কুলের শিক্ষক। দীর্ঘদিন ধরে কাজ করছেন নারীদের অধিকার এবং নিরাপত্তা রক্ষায়। শিউলির পাশেও দাঁড়িয়েছেন হৃদয় উজাড় করা সহমর্মিতা বোধ থেকেই।

রাশেদা বেগম

রাশেদা আপার কাছে জানতে চাইলাম সমাজের এই অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের উপায় সম্পর্কে। একজন প্রখর বাস্তববাদীর মতোই তিনি উত্তর দিলেন। বললেন, “এই পুরুষতান্ত্রিক সমাজে শিউলির পরিবারে পুরুষ নামক অভিভাবক নেই; আর এদেশের একটি পরিবারে পুরুষ অভিভাবক না থাকর মানে হলো, সেই পরিবারকে সইতে হবে অবর্ণনীয় অবহেলা ও নির্যাতন।” এই যেন অমোঘ সত্য।

শেষ করতে চাই সমসাময়িক একটি প্রসঙ্গ টেনে। মহামারিতে কেন বাড়ছে নারীর প্রতি নির্যাতন?

ব্র্যাকের সামাজিক ক্ষমতায়ন কর্মসূচির তথ্যানুযায়ী, ২০২০ সালের জানুয়ারি থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত এই মহামারির সময়েও বাল্যবিবাহসহ নারী ও শিশু নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে ৯৬৭২টি। কর্মসূচির হিসাব অনুযায়ী গত বছরের এই সময়ের তুলনায় যা প্রায় ২৪% বেশি। কোন অজুহাতে, ক্ষোভে, অভাবে বা প্রবৃত্তিতে নারীর প্রতি পুরুষের এই পাশবিক আচরণ?

ধর্ষক আলামিনের বয়স তখন ছিল ২২। আজ এই মহামারির সময়ে যার এমন বয়স, ঘরবন্দী এবং মানসিক চাপে থাকায় সেও কি নারীদের কেবল একটি ‘লোভনীয় জিনিস’ হিসেবেই দেখে? আমাদের সমাজ ব্যবস্থা কী তবে পুরুষতান্ত্রিক মানসিকতা দ্বারাই নিয়ন্ত্রিত? যেখানে শিউলির টিকে থাকা ছাড়া আর কোনো লক্ষ্যই নেই, এই অবস্থা কী পুরষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থা এবং মূল্যবোধের প্রতিফলন? নাকি নিরাপত্তাবোধের অভাব? নাকি হতে পারে দুটোই? শিউলির মতো এমন হাজারো নারী ও শিশু যারা নির্যাতিত হচ্ছে, তাদের মূলধারায় নিয়ে আসার জন্য আমাদের করণীয় কী?

 

সম্পাদনা এবং সহযোগিতায়- তাজনীন সুলতানা, সাঈদা বিলকিস বাণী

4.2 12 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
1 Comment
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Jahangir Alam
Jahangir Alam
3 years ago

ধন্যবাদ ব্রাক কে।

Last edited 3 years ago by Jahangir Alam