আলো হাতে চলিয়াছে আঁধারের যাত্রী

August 2, 2018

আজ আপনাদের সঙ্গে কয়েকজন নারীকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, যারা সকলেই নিজ নিজ কাজে অনন্য। প্রথাগত জীবনের বাইরে আসার জন্য যে লড়াই করতে হয়েছে, সেই লড়াইই তাদেরকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা।

বাংলাদেশ এগিয়ে চলেছে। এগিয়ে চলেছে আমাদের নারীরা। পথেঘাটে মেয়েরা স্কুটি চালাচ্ছে, হোন্ডা চালাচ্ছে- এ আর কোনো নতুন দৃশ্য নয়। নারী ক্রিকেটাররা বিশ্বজয় করে ঘরে ফিরেছে। অবাক পৃথিবী। অবাক বাংলাদেশের মানুষ।

আমাদের এই বাঘিনীরা কত অবহেলায়, কত অনাদরে বেড়ে উঠেছে গ্রামেগঞ্জে। সুবিধাবঞ্চিত সেই মেয়েরা আজ আমাদের দেশের জন্য যে সম্মান বয়ে আনছে, তা অভাবনীয়। এই অগ্নিকন্যাদের প্রতি শ্রদ্ধায় আপনা থেকেই মাথা নিচু হয়ে আসে।

আজ আপনাদের সঙ্গে আরও কয়েকজন নারীকে পরিচয় করিয়ে দিচ্ছি, যারা সকলেই নিজ নিজ কাজে অনন্য। প্রথাগত জীবনের বাইরে আসার জন্য যে লড়াই করতে হয়েছে, সেই লড়াইই তাদেরকে দিয়েছে আত্মবিশ্বাস। সমাজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার যোগ্যতা।

লতিফা আক্তার শিমু

ইঞ্জিনিয়ার (লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং)

লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ক্ষেত্রে লতিফা আক্তার শিমু একটি ব্যতিক্রমী উদাহরণ। ১৯৯৭ সাল থেকে তিনি এই ক্ষেত্রে কাজ করছেন। প্রথমে তিনি তার বাবার ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষণার্থী  হিসেবে কাজ শুরু করেছিলেন। এখন তিনি নিজেই এই প্রতিষ্ঠানটির মালিক।  টঙ্গীতে অবস্থিত প্রতিষ্ঠানটির নাম ‘শিমু ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ।’ তার স্বামী  এই প্রতিষ্ঠানে একজন কর্মী হিসেবে আছেন। একটি চমৎকার ব্যাপার হলো শিমু তার স্বামীকে লেদ মেশিন এবং শেপার মেশিন চালাতে  ট্রেনিং দিয়েছেন। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এই বিষয়টি নিশ্চয়ই ব্যাতিক্রমী।  শিমু ২০১৬ সালে, বাংলাদেশ ইঞ্জিনিয়ারিং ইন্ডাস্ট্রির ‘ওনার্স এসোসিয়েশনের ইনফরমেশন সেক্রেটারি’  হিসেবে  নির্বাচিত হয়েছিলেন। কথাপ্রসঙ্গে  শিমু জানালেন, তার দ্বিতীয় বাচ্চাটি জন্ম নেওয়ার সময় তিনি তার কাজ থেকে তিন বছরের মতো ছুটি নেন। তার ছুটিতে থাকাকালে স্থানীয় অনেকে এই ব্যবসা শুরু করে দেয়। দিনে দিনে এই ব্যবসায় তার বেশ কিছু প্রতিদ্বন্দ্বী দাঁড়িয়ে যায়। তবু শিমু তার ব্যবসায় চালিয়ে যেতে মনস্থির করেন। তিনি তার মার্কেটিং স্কিল বাড়িয়ে বেশি বেশি খদ্দেরের সঙ্গে যোগাযোগ শুরু করেন এবং আয় বাড়াতে সক্ষম হন।  প্রথম দিকে তিনি মার্কেটিং বিষয়ে তেমন কিছু জানতেন না। তাই কাজ  জোগাড় করার জন্য তাকে তৃতীয় পক্ষের সহায়তা নিতে হতো। শিমু নিজেই সরাসরি সবার সাথে যোগাযোগ করার সিদ্ধান্ত নেন। তিনি বুঝলেন এতে সার্ভিসটা আরও ভালো দেওয়া সম্ভব হবে এবং আয়ও বাড়বে। আর সেই কারণেই তিনি এই ব্যবসাটি ভালোভাবে শেখার জন্য  ‘progress’-  এর কাছ থেকে ট্রেনিং নেওয়ার জন্য আগ্রহী হয়ে ওঠেন। এখন তিনি আল-আরাফা ইসলামিক ব্যাংকের সঙ্গে তার ব্যবসার অর্জিত টাকার লেনদেন করছেন। এলাকার অন্যদের ব্যবসায়িক প্রসারে এখন আর মোটেও চিন্তিত নন। কারণ তিনি তার নিজের ব্যবসাটা বোঝেন এবং কাজটাকে ভালোবাসেন। ইঞ্জিনিয়ারিং সেক্টরে  ইতিমধ্যে তিনি তার এলাকায় একটি স্থান তৈরি করতে পেরেছেন। কারিগরি ক্ষেত্রে তিনি তার সর্বস্ব দিয়ে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে  মেয়েদের কাজের  পরিসর আরও বাড়িয়ে দিতে চান।

ফাহমিদা তাসনিম

ইন্সট্রাকটর, ব্র্যাক-আইএসডি

ফাহমিদা সেলাই মেশিন অপারেশনের একজন প্রশিক্ষক। তিনি  ব্র্র্যাকের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগামে কাজ করেন। চাকরির পাশাপাশি পরিবারের অন্যান্য কাজও  দক্ষতার সঙ্গে সম্পন্ন করেন ফাহমিদা। কিছুদিন আগেও ভালো একটি চাকরি পাওয়ার জন্য তিনি অনেক সংগ্রাম করেছেন।  তখন তার সময়গুলো কাটছিল নিস্তরঙ্গভাবে। সেখানে হতাশা এবং ক্লান্তিই ছিল তার বন্ধু।  সেই হতাশার মুহূর্তে তিনি জানতে পারেন, ব্র্যাকের আইএসডি  প্রোগ্রাম , সেলাই শেখার ট্রেনিং দিচ্ছে। ফাহমিদা যথাযথ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ করেন এবং সেখানে তিনি লেবেল-৪ প্রশিক্ষণটি খুবই সাফল্যের সঙ্গে সম্পন্ন করেন। শুধু তাই নয়, নিজের যোগ্যতা ও কাজের দক্ষতার কারণে তিনি ওই ইনস্টিটিউশনেরই প্রশিক্ষক হিসেবে যোগদানের প্রস্তাব পান। কোনো দ্বিধা না করে ফাহমিদা প্রস্তাবটি গ্রহণ করেন। ফাহমিদা সেই সাহসী নারীদের একজন যিনি কিনা একটি আপাতকঠিন চাকরিতে যোগদান করে তার নিজের জীবনটাকে আমূল বদলে ফেলেছেন। তার জীবন আগের চেয়ে এখন অনেক অর্থবহ ও আনন্দঘন।  ফাহমিদা বলেন, ‘আমার শিক্ষার্থীরা যখন আমার কথা অনেক মনোযোগ দিয়ে শোনে, তখন নিজেকে বেশ ক্ষমতাসম্পন্ন মানুষ বলে মনে হয়। এরকম অনুভূতি আগে আমার কখনও হয়নি।’

মোমেনা আক্তার

সেলাইকন্যা

সাধারণের চেয়ে মোমেনা কিছুটা খর্বাকৃতির। সে জন্য ছোটবেলায় সে স্কুলে যেতে চাইত না।  স্কুলে যায়নি বলে  তার জীবনে ছেলেবেলার তেমন কোনো উজ্জ্বল স্মৃতি নেই।

যখন সে কিশোরী, তখন সে কাজের সন্ধানে বাইরে বের হতে বাধ্য হয়। কারণ  মোমেনা কারও উপরে বসে খেতে চায়নি। তার আত্মমর্যাদাবোধ অত্যন্ত প্রখর। মোমেনা স্থানীয় একটি পোশাক কারখানায় চাকরি পায়। কিন্তু তাকে একজন পুরুষ সহকর্মী নানাভাবে উত্ত্যক্ত করতে শুরু করলে  সেখানে কাজ অব্যাহত রাখতে পারেনি।

একদিন ব্র্যাকের স্কিল ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের লোকজন তার কাছে গিয়ে তাদের ট্রেনিং প্রোগ্রামের কথা বলে। ট্রেনিং প্রোগ্রামে অংশ নেওয়ার জন্য সে মনস্থির করে ফেলে। শুরু হয় ট্রেইনিং।  শুরুতে মেশিন চালানোটা রীতিমতো কষ্টকর  ছিল মোমেনার জন্য। কিছুদিন চালানোর পরে সে অনুভব করে সেলাই মেশিন চালানো তেমন কোনো কঠিন কাজ নয়। সে বাচ্চাদের ফ্রক, পাজামা বানায়। আর এই সব তৈরি হয়ে যাওয়া পোশাক তাকে এক আত্মতৃপ্তি দেয়। নিজের কাজ তার কাছে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ মনে হয়। নিজের প্রতি তার আস্থা তৈরি হয়। তার উপর কেউ আস্থা রাখুক, সারাজীবন মোমেনা সেটাই চেয়েছে। এখন মোমেনার স্বপ্ন একটাই। সে  নিজেই যেন একটি টেইলারিং শপ দিতে পারে। তাহলেই তার জীবন হবে মুক্ত, স্বাধীন।

যে সুন্দর পৃথিবী নির্মাণে আমরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ, নারীপুরুষ উভয়ের অবদান ছাড়া সেই পৃথিবী নির্মাণ সম্ভব নয়। তাই নারীর ক্ষমতায়নে এবং সমঅধিকার প্রতিষ্ঠায় আমরা কাজ করেছি, করছি এবং করব।

0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments