আত্মহত্যা প্রতিরোধ: কিছু ভ্রান্ত ধারণা এবং তার প্রতিকার

October 10, 2019

আত্মহত্যা বিষয়ে বিষন্নতায় আক্রান্ত কারও সঙ্গে খোলামনে কথা বলা ভীষণ উপকারী। কিন্তু মনে রাখতে হবে আপনার কথা বলার ধরনে যদি কটূক্তি, অশ্রদ্ধা/অসম্মান, অযাচিত উপদেশ ইত্যাদির একটিও বিদ্যমান থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির আত্মহত্যার ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে।

 

আত্মহত্যা বিষয়ে আমাদের অনেকের মনেই কিছু ভ্রান্তধারণা রয়েছে। এই মিথ বা ভ্রান্তধারণা নিয়ে কথা বলা খুবই জরুরি। আত্মহত্যা প্রতিরোধবিষয়ক সংগঠন ‘কান পেতে রই’-এর প্রশিক্ষক এবং গবেষক হিসেবে আমি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় ২০১৩ সাল থেকে এখন পর্যন্ত প্রায় ৫৮টির মতো প্রশিক্ষণ এবং কর্মশালা পরিচালনা করেছি। আমার সেই অভিজ্ঞতা দারুন ভাবে কাজে লেগেছে ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অফ পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক ইউনিভার্সিটিতে চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী হিসেবে যোগ দেবার পরে। এখানে আমাকে বাংলাদেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা, নানান অর্থনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় পরিসর থেকে মিডওয়াইফারি পড়তে আসা তরুনীদের সাথে ঘনিষ্ট ভাবে কাজ করতে হয়েছে। আত্মহত্যা প্রতিরোধে তাদের সাথে নিয়মিত কাজ করেছি, তাদের কথা শুনেছি। তাদের মানসিকভাবে সুস্থ রাখতে প্রশিক্ষণের আয়োজন করেছি। মানসিক স্বাস্থ্যবিষয়ক প্রশিক্ষণে আমি সবসময়ই আত্মহত্যার মিথ সম্পর্কিত আলোচনাটিকে গুরুত্ব দিই।

বিশেষ এই সেশনে আত্মহত্যা সম্পর্কিত কিছু প্রশ্ন সাধারণত আমি অংশগ্রহণকারীদের করে থাকি। একটি বাক্য বলি, তারপর প্রশ্ন করি, বাক্যটি সত্য না মিথ্যা সেটা জানতে চাই। প্রশ্নটা করার পরই বেশ হৈ-হুল্লোড় হয়। কেউ সত্যের পক্ষে আর কেউ মিথ্যার পক্ষে হাত তোলে। কিন্তু একটি বিশেষ প্রশ্নে সবাইকে চিন্তায় পড়তে দেখি-

প্রশ্নটি হলো, ‘বিষন্নতায় আক্রান্ত কোনো ব্যক্তিকে আত্মহত্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করার মানে তার মাথায় আত্মহত্যার বীজ বুনে দেওয়া বা তাকে আত্মহত্যা করতে উৎসাহিত করা। জিজ্ঞেস করি, কথাটি সত্য নাকি মিথ্যা?’

এক্ষেত্রে আমি দলীয় উত্তর না নিয়ে ব্যক্তিগত মতামতের প্রতি মনোযোগ দিই। প্রত্যকের কাছ থেকে আমি তার ভাবনা সম্পর্কে জানতে চাই। আমি লক্ষ্য করেছি, অনেকেই এই প্রশ্নের উত্তরে বলেছেন, ধারণাটি তারা সঠিক বলে মনে করেন।

এ থেকেই জনসাধারণের মধ্যে আত্মহত্যা সম্পর্কিত বাস্তবিক ধারণা এবং তথ্যের ঘাটতি রয়েছে তা বোঝা যায়। উল্লিখিত বাক্যটি আসলে পুরোপুরি একটি ভ্রান্তধারণা। সত্য হলো, মনকষ্টে ভোগা কিংবা বিষন্নতায় আক্রান্ত কারো সাথে আত্মহত্যার কথা বলা মানে তাকে আত্মহত্যায় উদ্বুদ্ধ করা নয়। বরং এই ছোট্ট প্রশ্নটির কারণেই হয়তো সে মানুষটি নিজেকে গুরুত্বপূর্ণ ভাববে। মনে করবে, কেউ তার কষ্টের গভীরতা অনুভব করতে পেরেছে। এই প্রশ্নের উত্তর দিতে গিয়ে বিষন্নতায় আক্রান্ত ব্যক্তি তার ভেতরে থাকা চিন্তা এবং অনুভূতি নিয়ে খোলামনে আলোচনা করার সাহস পাবে, যা তার মনকে শান্ত করবে।

সাধারণভাবে আমরা মানসিক স্বাস্থ্যসম্পর্কিত বিষয়ে কথা বলতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করি না। নিজেদের কথা লুকিয়ে রাখি এবং অন্যদের কথাও শুনতে চাই না। আমাদের এই দৃষ্টিভঙ্গি ও সামাজিক প্রেক্ষাপটে এই ধরনের একটি প্রশ্ন হয়তো কথোপকথনের সূচনা করতে পারে। আত্মহত্যা নিয়ে আমাদের বেশিরভাগেরই মনে এক ধরনের কঠিন দেয়াল রয়েছে, রয়েছে স্টিগমা। আর তা থাকলে নিজেকে বা অন্যকে সাহায্য করা সম্ভব না। তাই প্রথমে আমাদের নিজের মধ্যে থাকা ভ্রান্তধারণা বা চিন্তাগুলোকে দূর করতে হবে।

আত্মহত্যার উদ্দেশ্য মরে যাওয়া নয় বরং কোনো একটা কঠিন অবস্থা থেকে মুক্তির উপায় হিসেবেই একজন মানুষ তা বেছে নেয়। একজন মানুষ যখন আর কষ্ট সইবার মতো অবস্থা থাকে না, যখন কোনো কঠিন বিপদে পড়ে কিংবা তার কাছে যখন বেঁচে থাকার চাইতে মরে যাওয়া অর্থবহ হয়ে ওঠে-এমন পরিস্থিতিতে সে মুক্তির একটি উপায় হিসেবে আত্মহত্যাকে বেছে নেয়। এর ফলে তার যুক্তি দিয়ে চিন্তা করার ক্ষমতা এবং সমস্যা সমাধানের দক্ষতা হ্রাস পায়। মনোবিজ্ঞানের ভাষায় একে আমরা বলি ‘টানেল ভিশন’ (Tunnel Vision)। এর অর্থ হলো তার মধ্যে চিন্তা করার সীমাবদ্ধতা চলে আসে। সে ভাবে, আমার সঙ্গে এরকম হয়েছে, আমি ব্যর্থ। সুতরাং আমার মরে যাওয়াই শ্রেয়। এরকম অবস্থায় কেউ এসে যদি তার প্রতি সহমর্মিতার প্রকাশ করে তখন কিন্তু সে তার ভেতরে জমানো চিন্তা বা অনুভুতি নিয়ে কথা বলবার সুযোগ পাবে। এতে তার ভেতরে যে ‘টানেল ভিশন’ তৈরি হয়েছিল তা ধীরে ধীরে দূর হবার সম্ভাবনা তৈরি হবে।

আত্মহত্যা বিষয়ে বিষন্নতায় আক্রান্ত কারও সঙ্গে খোলামনে কথা বলা তাই ভীষণ উপকারী। কিন্তু মনে রাখতে হবে আপনার কথা বলার ধরনে যদি কটূক্তি, অশ্রদ্ধা/অসম্মান, অযাচিত উপদেশ ইত্যাদির একটিও বিদ্যমান থাকে, তাহলে সেই ব্যক্তির আত্মহত্যার ঝুঁকি আরও বেড়ে যেতে পারে। প্রশ্ন করা বা কথা বলার সময় নিচের বিষয়গুলোর প্রতি খেয়াল রাখাটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ-

  • ব্যক্তির কষ্ট অনুভব করা
  • খোলামনে কথা শোনা
  • ব্যক্তিগত মানদন্ডে বিচার না করা
  • ধর্মীয় মানদন্ডে বিচার না করা
  • জাজমেন্টাল প্রশ্ন না করা
  • উচিত/অনুচিত শিক্ষা না দেওয়া
  • উপদেশ দেওয়া থেকে বিরত থাকা
  • মিথ্যা আশ্বাস না দেওয়া
  • গোপনীয়তা বজায় রাখা

আত্মহত্যার ভ্রান্তধারণার পাশাপাশি এর বিপদসংকেতগুলো সম্পর্কেও জানতে হবে এবং যখন কারও মধ্যে লক্ষণগুলো প্রকাশ পাবে তখন নিজে থেকেই চেষ্টা করুন তার সঙ্গে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে তুলতে। ‘কেমন আছ?’ এরকম সহজ প্রশ্ন দিয়ে কথা শুরু করুন। কিছুটা সহজ হয়ে এলে আপনি আত্মহত্যার চিন্তুা করছে কিনা সেই প্রসঙ্গে কথা শুরু করতে পারেন। মনে রাখতে হবে সামাজিক ভাবে হেয় হবার ভয়ে আমরা সাধারনত নিজেদের ব্যক্তিগত সংকট নিয়ে সহজে কথা বলতে চাই না। চরম মানসিক দূর্ভোগেও কারো কাছে সাহায্য চাইতে পারি না।

জীবনের কোনো-না-কোনো সময়ে বেশিরভাগ মানুষই একবার হলেও আত্মহত্যাপ্রবণ হয়ে থাকে। মনে রাখতে হবে সঠিক যত্ন, সহযোগিতা এবং চিকিৎসায় আত্মহত্যাসহ অধিকাংশ মানসিক সমস্যা কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।

 

রুবিনা জাহান
চিকিৎসা মনোবিজ্ঞানী
ব্র্যাক জেমস পি গ্র্যান্ট স্কুল অব পাবলিক হেলথ, ব্র্যাক উইনিভার্সিটি
মানসিক সহায়তা এবং আত্মহত্যা প্রতিরোধমূলক হেল্প লাইন “কান পেতে রই” এর প্রশিক্ষক এবং গবেষক
rubina.rumi@bracu.ac.bd

5 2 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
4 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
md sohel
md sohel
4 years ago

আমি ও আত্নহত্যা প্রবন ছিলাম।যখন আমি মারাত্বক একা ছিলাম।নিজেকে অন্ধকারে রেখে দিতাম।আত্নহত্যা করতে গিয়ে ও আমি ব্যর্থ হয়েছিলাম,বেঁচে যাওয়ার পর চরম লজ্জা পেয়েছি। পরিবারের সবাই আমাকে বাঁচিয়ে দিয়েছে।আচ্ছা আমাদের দেশে কোন ব্যক্তি যদি এই পরিস্থিতির মধ্যে যায় ঠিক সে সময়ে কোন হেল্প লাইনে ফোন করে কোন মনরোগ বিশেষজ্ঞদের সাথে কথা বলতে পারবে?এই ব্যবস্থা কি আছে???

ইবতিহাজ আহমেদ
Admin
Reply to  md sohel

একজন বা আরো কেউ কেউ কষ্ট দিয়ে অনেক ক্ষতি করে থাকলেও, কোথাও না কোথাও অন্য কেউ হয়তো থাকেন, যার সাথে কথা বললে ধরা দিতে পারে অন্য কোনো দিক। সময় নিয়ে আরেকবার ভেবে দেখলেই হয়তো বেরিয়ে যেতে পারে সমাধানের সেরকম কোনো না কোনো অন্য পথ। ভুল বোঝাবুঝি, বা এমনকি ভুলও, হতেই পারে। কিন্তু সেই ভুল ভাঙার বা সংশোধনের সব পথ বন্ধ করে দেয়ার মতো মস্ত ভুল হয়তো আর হয় না। প্রয়োজনে যোগাযোগ করুন:
BRAC Institute of Educational Development : https://www.facebook.com/braciedbracu/, 02-8812791

Afreen Sumu
Afreen Sumu
4 years ago

গুরুত্বপূর্ণ একটা বিষয় নিয়ে চমৎকার একটা আর্টিকেল। ভ্রান্ত ধারণাগুলো এখানে খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরেছেন। আত্মহত্যা প্রতিরোধে সবার আগে ভ্রান্ত ধারণাগুলো দূর করাটাই সবচেয়ে জরুরী।

Avrodip
Avrodip
3 years ago

জীবনটা সত্যিই খুব সুন্দর আর রঙিন। হয়তো কখনো কখনো প্রকৃতির নিয়মেই জীবন বাঁধার সম্মুখীন হয়, পেরুতে হয় অনেক দীর্ঘ পথ। তবুও বেঁচে থাকার একটা লড়াই চলে সর্বদাই। জীবন থেমে থাকেনা। আত্মহত্যা কিন্তু কখনো কোনো সমস্যার শেষ হতে পারেনা। বরং একটু সাপোর্ট, একটু আশ্বাস, একটু ভরসাই পারে আমাদের জীবনের ইতি টানার মতো একটা অন্ধকার ধ্বংসাত্মক পথ থেকে আলোর ফিরিয়ে নিতে। ধন্যবাদ সেসব বিফ্রেন্ডারদের, যারা পৃথিবীর সেই নির্মম কশাঘাতে জীবনের ক্রান্তিকালে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষগুলোর মনে বেঁচে থাকার চূড়ান্ত উচ্ছ্বাসটুকুর বীজ বুনে দিতে কাজ করে চলেছেন। সর্বোপরি, গতিপথ বদলালেও জীবনের টুকরো টুকরো বর্ণিল গল্পগুলো মিলেই তৈরি হয় একটা জীবনের ইতিহাস।