দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮৭ শতাংশই কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়সহ নানা অনানুষ্ঠানিক পেশায় নিয়োজিত। ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট চাকরি পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুসারে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখের মতো। তাদের অধিকাংশই তরুণ। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে।
একসময় অন্যদের মতো ঘুরে ঘুরে চাঁদা তোলাই ছিল আঁখির কাজ। তৃতীয় লিঙ্গ- যারা হিজড়া নামেও পরিচিত, আঁখি তাদেরই একজন। কিন্তু সে চাঁদা তুলে জীবন কাটাতে চায়নি। এসএসসি পর্যন্ত পড়ালেখা করেছিল। তাই ব্র্যাকের স্টার প্রকল্পের টেইলারিং কোর্স করাটাকে সে জীবন গড়ার সুবর্ণ সুযোগ হিসেবেই দেখল। কালবিলম্ব না করে টেইলরিং কোর্সে শিক্ষানবিশ হিসেবে কাজ শুরু করল। প্রশিক্ষণ শেষে ২০১৬ সালে এমসিপি (ওস্তাদ)-র দোকানে চাকরি হয় তার। সে মর্যাদাপূর্ণ জীবনযাপনের সুযোগ পেল। জীবন নিয়ে সে তৃপ্ত, আত্মবিশ্বাসী।
বাংলাদেশ মধ্যম আয়ের দেশের পরিণত হতে যাচ্ছে। আঁখির লড়াকু রূপ তারুণ্যের শক্তিরই বহিঃপ্রকাশ বলা যেতে পারে। কিন্তু ভিন্ন চিত্রও রয়েছে। দেশের মোট শ্রমশক্তির ৮৭ শতাংশই কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসায়সহ নানা অনানুষ্ঠানিক পেশায় নিয়োজিত। ৪৭ শতাংশ গ্র্যাজুয়েট চাকরি পাচ্ছে না। আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার সংজ্ঞা অনুসারে দেশে বেকারের সংখ্যা ২৭ লাখের মতো। কিন্তু সাম্প্রতিক হিসাব বলছে পৌনে ৫ কোটি লোক কর্মহীন। তাদের অধিকাংশই তরুণ। এই অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য সরকার দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার ওপর জোর দিচ্ছে। ব্র্যাকও এই একই ধারায় কাজ শুরু করেছে। এজন্য সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে নানাবিধ কার্যক্রম চালু করেছে।
ঢাকার আশকোনায় প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব স্কিলস ডেভেলপমেন্ট পেশাভিত্তিক প্রশিক্ষণ কোর্স চালু করেছে। এখানে জাতীয় দক্ষতা উন্নয়ন নীতি অনুসরণে বিশ্বমানের সর্বাধুনিক কারিগরি প্রশিক্ষণপদ্ধতিতে ইলেকট্রিক ইন্সটলেশন অ্যান্ড মেইনটেন্যান্স, রেফ্রিজারেশন অ্যান্ড এয়ারকন্ডিশনিং, সুইং মেশিন অপারেশন, ফুড অ্যান্ড বেভারেজ সার্ভিসেস, হাউজকিপিং অকুপেশন, আইটি, রিটেইল সেলস ইত্যাদি নানা বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। অষ্টম শ্রেণি পাশ এবং আঠারো বছর বয়সি তরুণ-তরুণীরা এখানে অত্যাধুনিক ওয়ার্কশপে প্রশিক্ষণ নিতে পারে।
১৪ থেকে ১৮ বছরের সুবিধাবঞ্চিত ছেলেমেয়েদের জন্য প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করছে স্কিলস ট্রেনিং ফর অ্যাডভান্সিং রিসোর্সেস (স্টার) প্রকল্প। স্টার প্রকল্পে শিক্ষানবিশদের বয়স উপযোগী বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেমন: টেইলরিং অ্যান্ড ড্রেস মেকিং, বিউটি সেলুন, আইটি সাপোর্ট টেকনিশিয়ান, উড ফার্নিচার, মোবাইলফোন সার্ভিসিং, অ্যালুমিনিয়াম ফেব্রিকেশন, গ্রাফিক ডিজাইন ইত্যাদি। এই প্রকল্পে প্রশিক্ষণার্থীরা ওস্তাদের কাছে কাজ শেখে এবং চাকরি করার দক্ষতা অর্জন করে। এ ছাড়াও প্রশিক্ষণার্থীদের ব্যবসায়িক দক্ষতা, অধিকার, সামাজিক বিষয়, শ্রম আইন, লিঙ্গসমতা এবং প্রতিবন্ধিতা বিষয়ে ধারণা প্রদান করা হয়। স্টার প্রকল্পের আওতায় এ পর্যন্ত ২৮,৩৬৫ জনকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে এবং ৯৫ শতাংশ প্রশিক্ষণার্থীর জন্য কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা হয়েছে।
প্রোমোটিং স্কিলস অ্যান্ড প্রোডাক্টিভিটি এনহেন্সমেন্ট ফর রিজিলিয়েন্স (প্রোসপার) প্রকল্পটি স্টার মডেলের আদলে পরিচালিত হয়। তবে এই প্রকল্পে প্রশিক্ষণের জন্য ফি দিতে সক্ষম প্রশিক্ষণার্থীরাই যোগ দেয়। দক্ষ হাতে ব্যবসা সামাল দিতে বা ব্যবসা শুরুর আগে এ সম্পর্কে আরও বিশদভাবে জানতে কারিগরি দক্ষতাসম্পন্ন তরুণরা প্রোমোটিং বিজনেস ইনকিউবেশন ফর স্মল এন্টারপ্রিনিয়র (প্রমিজ) প্রকল্পে প্রশিক্ষণ নিতে আসে। তাদের জন্য মেন্টরিং সহায়তাসহ ব্র্যাক মাইক্রোফাইন্যান্সের মাধ্যমে সহজ শর্তে ঋণের ব্যবস্থা করে দেয় প্রমিজ। প্রশিক্ষণের পাশাপাশি পুঁজিরও জোগান দিচ্ছে প্রমিজ। প্রো-পুওর গ্রোথ অব রুরাল এন্টারপ্রাইজেস থ্রো সাসটেনেবল স্কিল ডেভেলপমেন্ট (প্রোগ্রেস) প্রকল্প লাইট ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। এ পর্যন্ত ৫,০০০ ক্ষুদ্র ও কুটির শিল্প প্রতিষ্ঠানের উৎপাদন দক্ষতা বৃদ্ধি, শোভন কর্মপরিবেশ সৃষ্টিতে জ্ঞান ও দক্ষতা বৃদ্ধি, মার্কেট লিংকেজ, সাংগঠনিক দক্ষতা বৃদ্ধি ও নেটওর্য়াক ইত্যাদি বিষয়ে কাজ করছে প্রোগ্রেস। এপর্যন্ত ১,০০০ প্রশিক্ষণার্থীকে প্রোগ্রেসর মাধ্যমে বিভিন্ন ট্রেডে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। ২০১৯ সালে আরও ৯,০০০ প্রশিক্ষণার্থী যোগ হবে।
সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি ও বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণের মাধ্যমে জীবন গড়ার সুযোগ দিতে ব্র্যাক দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি এবং একসেস টু ইনফরমেশন(এটুআই) কর্মসূচির যৌথ উদ্যোগ ‘স্কিল ট্রেনিং একসেস ইন- জেনারেল এডুকেশন (স্টেজ)’ কাজ করছে। এই উদ্যোগের সঙ্গে যুক্ত নবম-দশম শ্রেণির শিক্ষার্থীরা এসএসসি সনদের পাশাপাশি কারিগরি বোর্ডের দক্ষতার সনদ লাভ করবে। এতে কোনো কারণে কেউ লেখাপড়া করতে না পারলেও বিশেষ কোনো ক্ষেত্রে দক্ষ হওয়ার কারণে উপযুক্ত কাজের সন্ধান পাবে।
গ্রামাঞ্চল থেকে গার্মেন্ট ফ্যাক্টরিতে চাকরি করতে আসা অদক্ষ কর্মীদের জন্য ইআরএমজি প্রকল্প সুইং মেশিন অপারেশনের ওপর প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকে। এর মাধ্যমে পোশাকশিল্পে যুক্ত হচ্ছে দক্ষ তরুণ জনগোষ্ঠী। দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচির ‘কর্ম’ উদ্যোগটি হচ্ছে দক্ষ, অদক্ষ এবং স্বল্পদক্ষ কর্মীদের জন্য একটি ডিজিটাল জব ম্যাচিং প্ল্যাটফর্ম। অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপের মাধ্যমে এখানে তারা সহজে চাকরির সন্ধান পান। আবার চাকরিদাতাও অ্যাপের মাধ্যমেই কাক্সিক্ষত শ্রমিক বা কর্মচারীর সন্ধান পান।
নদী দুর্বার গতিতে ছুটে চলে সাগরের পানে। হঠাৎ নদীর কথা কেন? বলছি কারণ, চলার পথে বাধা পেলেই সে তার গতিপথ পরিবর্তন করে নতুন পথে চলে। কিন্তু তার লক্ষ্য ঠিক থাকে। দক্ষতা উন্নয়ন কর্মসূচি তরুণদের দক্ষ করে তোলার প্রয়াসে কাজ করে যাচ্ছে। যারা পিছিয়ে পড়ছে তাদের জন্য নানাবিধ সুযোগ তৈরি করছে। তরুণরা আপন গতিতেই পথ গড়ে নিচ্ছে। তারুণ্যের শক্তিতে এগিয়ে যাচ্ছে দেশ।