মিয়ানমার থেকে আগত মানুষের জন্য যে অস্থায়ী আবাসগুলো তৈরি করা হয়েছে, সেখানে সন্ধ্যেটা যেন একটু আগেভাগেই নামে, আর রাতগুলো তাই হয় অনেক দীর্ঘ।। গুমোট অন্ধকার যেন মানুষগুলোকে আরও বিষণ্ণ করে না তোলে, তাই পরিবারগুলোর মাঝে ব্র্যাক বিতরণ করছে সোলার ল্যাম্প।
আট মাসের অন্তঃসত্ত্বা তাহেরা। দুই বছর আগে তার স্বামী সালামের সাথে তার বিয়ে হয়। গতবছর তিনি প্রথমবারের মত অন্তঃসত্ত্বা হোন, কিন্তু দূর্ভাগ্যজনকভাবে সেই সন্তান ভূমিষ্ঠ হবার আগেই মারা যায়।
তাহেরা এবং সালামের সাথে আরও এসেছেন তাদের পরিবারের বেশ কিছু সদস্য। তাহেরার মা, সালামের ভাই এবং স্ত্রী ও চার সন্তান। এদের সকলকে পথ দেখিয়ে নিয়ে এসেছেন তাদের গ্রামের এক পরিচিত ব্যক্তি, নাম রহমত। মিয়ানমারের বাসিন্দা হলেও রহমত গত আট বছর ধরে কক্সবাজারের একটি নিবন্ধিত ক্যাম্পে বাস করছেন।
তাহেরাদের জন্য এ যাত্রা ছিল অত্যন্ত দীর্ঘ, কঠিন এবং ভয়াবহ রকমের বিপদসংকুল।
“বউটার ভালোর জন্য নিজের পক্ষে যা সম্ভব সবই চেষ্টা করেছি। কি যে ভয়ংকর সব অভিজ্ঞতা আমাদের হয়েছে তা বর্ণনা করতে পারব না আমি। প্রথমবার গর্ভপাতের পর আমরা খুবই সচেতন ছিলাম, সাবধান ছিলাম। কিন্তু দেখলেন, সেই শেষ সময়ে এসেই গন্ডগোল বেঁধে গেল আবার।”
তাহেরার মা নিজেও ব্যাথায় ঘুমোতে পারেন না, সারারাত যন্ত্রণায় কাঁতরান এবং কাঁদেন। তাহেরার নিজের পা দুটি আগেই ফুলে ছিল, এখন সেই যন্ত্রণা তিনি আর সহ্য করতে পারেন না।
“বিশ্বাস করেন, আমি যদি পারতাম মা আর বউ দু’জনকেই কাঁধে করে বয়ে নিয়ে আসতাম। ওই যাত্রার প্রত্যেকটা মুহূর্ত ছিল ওদের জন্য অকল্পনীয় কষ্টের, অথচ পুরো দুই সপ্তাহ ধরে (যাত্রার) এই অসহ্য যন্ত্রণা ওদের সহ্য করতে হলো।”
একটি টিলার একেবারে চূড়ার দিকে অবস্থিত তাহেরার তাবুটি একজন ব্র্যাককর্মী বিশেষভাবে চিহ্নিত করেন এবং তাদের একটি সোলার ল্যাম্প দেওয়া হয়।
“অন্যদের থেকে অনেক দেরিতে এসে পৌঁছানোয় আমরা কোন সুবিধাজনক স্থানে থাকার জায়গা পেলাম না যেখান থেকে আমরা সহজে সহায়তা পেতে পারি। তাই কোনমতে এখানেই (এখন যেখানে থাকছেন) থাকার ব্যবস্থা করে নিতে হলো।”
তাহেরাদের তাবু পর্যন্ত পৌঁছাতে গলদঘর্ম হতে হয়েছে ব্র্যাককর্মীদের। অবিরাম বর্ষণে রাস্তা বলতে কিছু সেখানে আর অবশিষ্ট নেই; নরম কাঁদা মাড়িয়ে, এখনো অবশিষ্ট থাকা কিছু ছোট ছোট গাছ ধরে ধরে, হাতে ধরা বস্তায় জিনিসপত্র নিয়ে কোনভাবে সেখানে পৌঁছানো যায়। এ যেন এক কঠিন সংগ্রাম।
এধরণের উঁচু এবং দূর্গম জায়গায় তাহেরার মত বিপন্নদের কথা বিশেষভাবে বিবেচনা করে ব্র্যাক সোলার ল্যাম্প বিতরণ কর্মসূচি শুরু করেছে। পুরো এলাকা জুড়েই প্রত্যেক অন্তঃসত্ত্বা নারী যেন নিরাপদ থাকেন, তাই তাদের হাতে হাতে তুলে দেয়া হচ্ছে এই সোলার ল্যাম্প। দূর্গমতম এলাকায় তাবু থেকে তাবুতে ঘুরে ঘুরে, অন্তঃসত্ত্বা নারীদের খুঁজে বের করছে আমাদের কর্মীবাহিনী- বিপন্ন মানবতার সেবায় যাদের অবদান এই তাবুগুলোতে অমূল্য।
গত চার সপ্তাহে মিয়ানমার থেকে আগত মানুষের সংখ্যা ৫ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে, এবং বলা বাহূল্য, এই সংখ্যা ক্রমবর্ধমান। অধিকাংশই থাকছেন অস্থায়ী আবাসগুলোতে। পরিবারগুলো একে অপরের কাছাকাছি থাকতে চান। তাহেরার আরও তিনজন বান্ধবীর সন্ধান মিলেছে, তারাও অন্তঃসত্ত্বা। প্রত্যেকে পেয়েছেন এই সোলার ল্যাম্প। দুঃসময়ে এই মানুষদের নিজেদের মধ্যে বন্ধন অটুট রয়েছে, কিন্তু আলো ছাড়া তারা ওই অন্ধকারে কি করে একজন আরেকজনের কাছে যাবেন?
এই সোলার আলো অস্থায়ী আবাসের কার্যক্রম আরও গুছিয়ে আনতে সাহায্য করছে, সেই সাথে যোগাযোগ হচ্ছে সহজগম্য। বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর সদস্যরাও সম্প্রতি ভূমিকম্পের ঝুঁকি কমাতে পাহাড়ি এলাকা থেকে মানুষদের সরিয়ে নিচু জায়গায় নিয়ে আসছেন। একই সাথে তারা সহায়তা কার্যক্রমকে কেন্দ্রীভূত করার চেষ্টা করছেন এবং শুরু করেছেন নতুন রাস্তা নির্মাণ।
সরকার এবং অন্যান্য সংস্থার তত্ত্বাবধানে ব্র্যাক তার সহায়তা কার্যক্রমের আওতা প্রতিনিয়ত বৃদ্ধি করছে। নারী ও শিশুদের স্বাস্থ্যসেবা আমাদের প্রধান অগ্রাধিকার; এছাড়াও আমরা বিশুদ্ধ পানি, পরিচ্ছন্ন ও জীবাণুমুক্ত উপকরণ সরবরাহ, শিশু সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বদ্ধপরিকর।