চারটি অফিসের দায়িত্ব তাঁর কাঁধে, অধীনস্থ কর্মীর সংখ্যাও কম নয়। হাজারো ঋণের আবেদন তাঁকে যথাযথভাবে দেখতে হয়। অফিসের এসব কাজের পাশাপাশি মেয়েকে তিনি বড় করছেন এবং কোন কোন দিন তাঁকে এলাকার মাস্তানদেরও সামলাতে হচ্ছে।
“আমি পড়াশোনা না জানলে এসব কিছুই ঘটতো না,” তিনি অকপটে স্বীকার করেন এক বাস্তবতা।
ব্র্যাকের মাইক্রোফাইন্যান্স কর্মসূচির একজন এরিয়া ম্যানেজার হিসেবে খুলনার দৌলতপুর এলাকায় কর্মরত আছেন নাজমা পারভিন। বিগত ১৭ বছর ধরে তিনি নিজেকে তিল তিল করে গড়ে তুলেছেন, সাহসিকতা এবং অধ্যাবসায় দিয়ে জয় করতে চেয়েছেন সামনে আসা সকল প্রতিকূলতা।
১০ ভাইবোনের মধ্যে নাজমা সবার ছোট। উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষায় অংশ নেয়ার পরই তাঁর জন্য পরিবার থেকে বিয়ে ঠিক করে ফেলা হয়। এই পরিস্থিতি তিনি মেনে নেননি। প্রবল একাগ্রতার সাথে তিনি পারিবারিক এই চাপ উপেক্ষা করে, লক্ষ্যে স্থির থেকে ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি হয়ে নিজের লেখাপড়া চালিয়ে যান।
একজন মানুষের জীবনে শিক্ষা এবং চাকুরির গুরুত্ব নাজমা নিজের জীবন দিয়ে উপলব্ধি করতে পারেন। অনেকটা যেন আপনমনেই তিনি বলছিলেন, “এগিয়ে যেতে হলে তো কাজ করে যেতেই হবে।”
বহু বছর আগে যখন তিনি চাকুরি খুঁজছিলেন, তখন বন্ধুস্থানীয় একজনের কাছে ব্র্যাক সম্পর্কে জানতে পারেন। এই চাকুরি করাও ছিল আরেকটি চ্যালেঞ্জ। এ নিয়ে কম কাঠখড় পোড়াতে হয়নি। ইতিমধ্যে তাঁর বিয়ে হয়ে গেছে ঠিকই। তাঁর শ্বশুরবাড়ির ছিল দেশের অন্য আরও অনেক পরিবারের মতই রক্ষণশীল মনোভাব। এই পরিবারের খুব কম মেয়েই স্কুল পর্যায়ের পরও পড়াশোনা চালিয়ে যেতে পেরেছিল।
চাকুরির কথা শুনে শ্বশুরবাড়ির প্রায় সকলে একপ্রকার রূদ্রমূর্তি ধারন করলেন।
“পাড়াপড়শিরা কি ভাববে এমন দেখলে”
“এই পরিবারের মেয়েরা ঘরেই থাকে আর সংসারের দেখভাল করে”
“তুমি স্কুলে একটা চাকরি নিতে পার। কোনভাবেই অপরিচিত মানুষদের সাথে কাজ করতে পারবা না”
এমনকি এই মানুষগুলো নাজমার স্বামীর কাছে পর্যন্ত গিয়ে বলে যে সে বোধহয় আরও একজন কম শিক্ষিত মানুষকেই বিয়ে করলে ভালো করত। তাহলে সে স্বামীর কথার বাইরে নড়চড় করারই সাহস পেত না।
নাজমা প্রতিদিন বাইক চালিয়ে ঘুরে বেড়াবেন এবং প্রতিনিয়ত অপরিচিত মানুষদের সাথে কথা বলবেন, কাজ করবেন- এ ছিল তাঁর স্বামীর কাছেও অকল্পনীয়। বয়সে তিনি নাজমার থেকে অনেক বড়, চিন্তাভাবনাতেও পারিবারিক সেই রক্ষনশীলতার স্পষ্ট ছাপ। নাজমার শান্ত করতে তিনি শুধু শিক্ষকতারই পক্ষপাতী ছিলেন।
২০০১ সালে নাজমা যখন ব্র্যাকে যোগ দেন, তখন তাঁর এলাকার সবচেয়ে স্বাভাবিক ব্যাপারই ছিল যে কোন মেয়েই ঘরের বাইরে এসে চাকরি করবে না, তাও এবার এনজিও’র মত কাজে। পুরুষ কর্মীদের আধিপত্যে তাঁকে যথেষ্ট বৈষম্যের শিকার হতে হয়েছে চাকরিতেও। ব্যাপারটা আরও জটিল হয়ে দাঁড়ায় যখন চাকরির আট মাসের মাথায় নাজমা জানতে পারেন যে তিনি মা হতে চলেছেন।
অন্তঃসত্তাকালীন সময়ও নাজমার বাইক বন্ধ থাকেনি, তিনি নিজের বাইক চালিয়ে গেছেন। নিজের কাজ করে গেছেন। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে গেছেন। দূর দূরান্তে গেছেন মানুষের সন্ধানে, নতুন সদস্য নিয়োগের খোঁজে। কথা বলে গেছেন অবিরাম গ্রামের নারীদের সাথে। মেয়ের জন্মের পর তৈরি হল নতুন বিড়ম্বনা, তিনি অধিকাংশ সময় বাইরে থাকবেন, মেয়ে খাওয়াদাওয়া কার সাথে করবে? দেখভাল তখন কে করবে মায়ের অবর্তমানে?
“আমি বুঝতাম না আমার এত খাটাখাটুনির পরেও কেন আমার আশেপাশের সব মানুষেরা, বিশেষ করে পুরুষ মানুষেরা আমার প্রতি প্রতিনিয়তই এমন একটি পরিস্থিতি তৈরি করে রাখত যেন আমি এই সমাজে কেবলমাত্র একটা বোঝা”।
প্রতিনিয়ত ঘরে বাইরে এমন সমস্যার সাথে লড়াই করতে করতে নাজমা দরদাম বা দেনদরবার বিষয়টিকে অসম্ভব দ্রুততার সাথে নিজের একটি শক্তিতে পরিণত করেন। “এভাবে আমি গুন্ডাপান্ডাগুলোকেও তাড়িয়ে দিতে সক্ষম হই, যারা আমাদের উপদ্রব করত”। তিনি এমন নির্বিকারভাবে কথাগুলো বলেন যেন মনে হয় এই কাজ তাঁর কাছে নিজের জামার ধূলো ঝারবার মতই! অথচ কিন্তু তিনি তাঁর অমায়িক হাসি দিয়ে মানুষের মন জয় করে অসংখ্য নতুন সদস্য সংগ্রহ করে চলেছেন আর তাদের মধ্যে ঋণ বিতরণ করছেন।
“আমি সদস্যদের সাথে আমার আপন ভাইবোনের মতই কথা বলি”।
একবার কিছু লোক তাঁকে প্রলুব্ধ করছিল তাদের কিস্তি কমিয়ে দেয়ার জন্য। “আমাকে খুব কায়দা করে পালিয়ে আসতে হয়েছিল তাদের সামনে থেকে” তিনি হাসতে হাসতে বলে চলেন, “নিজের কাজে সৎ আর মনোযোগী থাকলে আমার কি কাউকে ভয় পাবার কিছু আছে বলেন!”
সদস্যদের সাথে সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং এলাকার মাস্তানদের মোকাবেলা ছাড়াও, নাজমার আরও একটি বড় দায়িত্ব রয়েছে নিজের জীবনে। তাঁর ক্লাস নাইন পড়ুয়া একটি মেয়ে আছে। মায়ের চোখের মনি মেয়েটার এই মুহূর্তে চিন্তার অন্ত নেই; ইঞ্জিনিয়ারিং না ডিজাইন, কোনটা সে ভবিষ্যতে বেছে নেবে তাই নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দে কাটছে তাঁর দিন।
নাজমা চান তাঁর মেয়েটিও যেন মোটরবাইক চালাতে শেখে। “আমি চাই সে আলোকিত এবং স্বাবলম্বী হোক। তবেই একমাত্র সে সাহসিকতা এবং দৃঢ়তার সাথে বাস্তবতার মুখোমুখি হতে পারবে।”
নিজের পেশাগত সাফল্য এবং স্বাধীনভাবে এতদূর আসতে নাজমার পেরোতে হয়েছে অনেক চড়াই উতরাই। তাঁর শ্বশুরবাড়ি এখনও এই চাকরির বিরুদ্ধে, নিজের কাজকে সমর্থন করতে করতে ক্লান্ত হয়ে তিনি এখন তাদের থেকে আলাদা বসবাস করছেন।
“কাজ বন্ধ করে দিলে আমি আর স্বাধীন থাকতে পারব?” তিনি আত্মবিশ্বাসী ভঙ্গিতে বলে যান, “ঘরের কাজই যদি সারাজীবন করতে হয় তাহলে এত কষ্ট করে পড়াশোনা করে কি লাভ হলো!”
অতীতের ফেলে আসা কঠিন সংগ্রামের দিনগুলোর কথা স্মরণ করে নাজমা চোখের পানি লুকোতে পারেন না। তিনি মাঝে মাঝে ভাবেন কি করে তিনি আজকের অবস্থানে থাকতেন যদি ব্র্যাকে কাজ করার সুযোগটা তিনি কাজে না লাগাতেন?
“দিনশেষে আমি নিজে তো একজন নারী, আর আমি আমার এই পরিচয়ে গর্বিত।”
নাজমার মত নারীদের সংগ্রামী জীবনটাই আজ এদেশের আরও অগণিত নারীর শত প্রতিকূলতাকে জয় করে স্বাধীনভাবে কাজ করার দুয়ারটি উন্মুক্ত করছে। ব্র্যাকের পাশাপাশি থেকে তিনি শুধু তাঁর নিজের এলাকার নারীদের জন্যই কাজ করতে চান না, তিনি আজীবন কাজ করতে চান সারা দেশের নারীদের মঙ্গলের জন্য।