নির্যাতনের কথা বললে প্রথমেই আমাদের মনের মাঝে উঁকি দেয় শারীরিক, মানসিক, এবং যৌন নির্যাতনের কথা। কিন্তু নারীরা বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে নির্যাতন বা বৈষম্যের শিকার হন তার ব্যাপকতার কথা প্রায়শই আমরা গণ্য করি না।
রানুর (ছদ্ম নাম) বিয়ে হয়েছে প্রায় এক যুগ। তখন কী আর সে জানত তাঁর স্বামী জুয়ার নেশায় আসক্ত। সংসার খরচ দেয় না, নিজে যা রোজগার করে তার সবটাই এ পথে হারায়। রানুর কোনো নিষেধই শোনে না, উল্টো মানা করলে রাগারাগি আর মারধোর করে। একসময় নির্যাতন না সহ্য করতে পেরে রানু পা বাড়ায় ঢাকাশহরে। প্রথমে কিছুদিন রাস্তায় মাটিকাটার কাজ করে, পরে একটি গার্মেন্টসে চাকরি হয়। সারাদিন পরিশ্রমের পর বাড়ি ফিরলে জোটে গালাগাল আর মারধর। তার ওপরে নিজের উপার্জনের সিংহভাগই চলে যায় জুয়ার আসরে।
এভাবে কিছুদিন যাওয়ার পর রানু ফিরে যায় গ্রামের বাড়িতে। কিন্তু স্বামী সংসারের কোনো খোঁজই রাখে না। এদিকে দুটো সন্তানের মা হয়েছে রানু। এদের মুখে দুটো খাবার তুলে দিতে আর স্কুলে পাঠাতে রানু তাঁর জীবন বাজি রাখতে পারে। তাই আবারও আসে ঢাকায় রোজগারের আশায়। রানুর স্বামী এখন আর গায়ে হাত তোলে না, কিন্তু রানু তার উপার্জিত অর্থ ভোগ করতে পারে না। এর ওপর তার কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই।
রানু এখন বাসাবাড়িতে কাজ করে। নয়টা বাসায় কাজ করে প্রতিদিন যখন রাত ১১টার সময় ঘরে ফেরে তখন রানুর মনে হয় তার সব শক্তি নিঃশেষ হয়ে গেছে। খুব ভোরে উঠেই আবার কাজ শুরু করতে হয়। ঠিকমতো ঘুম তো হয়ই না, সময়ের অভাবে কখনও কখনও খাবারও খাওয়া হয়ে ওঠে না। এত কিছুর পর তার কষ্টে রোজগারের টাকা কেমন যেন হাওয়ায় মিলিয়ে যায়। কী করবে কিছুই বুঝে উঠতে পারে না। কখনও ভাবে সব ছেড়ে দূরে কোথাও চলে যাবে। কিন্তু সন্তানদের কে দেখবে? মন আর শরীরের ওপর জোর খাটিয়ে কোনোরকমে দিনগুলো পার করছে।
নির্যাতনের কথা বললে প্রথমেই আমাদের মনের মাঝে উঁকি দেয় শারীরিক, মানসিক, এবং যৌন নির্যাতনের কথা। কিন্তু নারীরা বিভিন্নভাবে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যে নির্যাতন বা বৈষম্যের শিকার হন তার ব্যাপকতার কথা প্রায়শই আমরা গণ্য করি না। নিম্ন, মধ্য এবং উচ্চবিত্ত সব শ্রেণিতেই রানুর মতো হাজারও নারী আছেন যারা নিজের উপার্জিত অর্থ ভোগ করতে পারেন না। অর্থনৈতিক সহিংসতার শিকার নারীরা মূলত সীমিত সম্পদে প্রবেশগম্যতা, সীমিত স্বাস্থ্যসেবাপ্রাপ্তি, কর্মসংস্থান, শিক্ষা ইত্যাদি ক্ষেত্রে প্রবেশ করতে না পারা, আর্থিক বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে বাধাপ্রাপ্ত হওয়া এবং সর্বোপরি বৈষম্যমূলক উত্তরাধিকার আইন এবং সম্পত্তির আইন দ্বারা বৈষম্যের শিকার হয়ে থাকেন।
কর্মক্ষেত্রে দেখা যায় নারীরা পুরুষদের সমপরিমাণ কাজ করেও অসম বা কম বেতন পেয়ে থাকেন। অর্থনৈতিক নির্যাতনের শিকার নারীরা অনেক সময় প্রয়োজনীয় চাহিদা হতে বঞ্চিতও হয়ে থাকেন। আবার অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়, সংসারে অভাবঅনটন না থাকলেও, পারিবারিক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা অর্থ নিয়ন্ত্রণের ক্ষেত্রে নারীর মতামতকে প্রাধান্য দেওয়া হয় না। কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করতে পরিবার থেকে অনেক সময় নিরুৎসাহিত এবং কখনও কখনও বাধা প্রদান করা হয়। আবার দেখা যায় যে, অনেক পুরুষ পরিবারের ভরণপোষণ দিতে পুরোপুরি অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করছেন। একদিকে নারীকে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হতে না দেওয়া, অন্যদিকে মৌলিক চাহিদা পূরণের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ দিতে অস্বীকৃত জানানো মানবাধিকার লঙ্ঘন।
শোষণমূলক সম্পর্ক থেকে মুক্তি পাওয়ার পরেও অনেক সময় অর্থনৈতিক নির্যাতন অব্যাহত থাকে। কারণ অর্থনৈতিক সহিংসতাসহ সব ধরনের সহিংসতা, অনেকক্ষেত্রেই পরবর্তী প্রজন্মকেও ছুঁয়ে ফেলে। দ্বন্দ্ব নিরসনে যখন সহিংসতাকে উপায় হিসেবে ব্যবহার করা হয় তখন তার প্রভাব শিশুমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ফেলে যা তাকেও উৎসাহিত করে পরবর্তী সময়ে এই আচরণে অভ্যস্ত হতে।
মূলত অর্থনৈতিক সহিংসতা দরিদ্রতাকে আরও গভীরতর করে। শিক্ষাক্ষেত্রে অগ্রগতি এবং উন্নয়নের সুযোগকে সীমিত করে ফেলে, ক্রমান্বয়ে যা শারীরিক নির্যাতনকে উৎসাহিত করে এবং পরবর্তীতে তা যৌন নির্যাতনের দিকে ধাবিত করে। ফলাফল হিসেবে আমরা দেখে থাকি বিভিন্ন যৌনবাহিত রোগের প্রকোপ, মাতৃমৃত্যু, শিশুমৃত্যু, নারী ও শিশুপাচার ইত্যাদি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে। যদিও অর্থনৈতিক সহিংসতা অন্যতম একটি জেন্ডারভিত্তিক নির্যাতন এবং অনেক নারী মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন, তথাপি এর ওপর তুলনামূলকভাবে গবেষণা কম হয়েছে।
নারীদের অর্থনৈতিক উন্নয়ন পরিবার বিশেষত বৃহত্তম অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিসরে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে। এরপরও অনেক নারীই একই কাজের জন্য পুরুষের তুলনায় কম মজুরি পেয়ে থাকেন, অনিরাপদ অবস্থায় কাজ করেন, ভূমি, সম্পদ ইত্যাদিতে প্রবেশাধিকার কম পান।
নারীপুরুষ সমতা প্রতিষ্ঠায় প্রয়োজন পিতৃতান্ত্রিক মূল্যবোধ, ধ্যানধারণা, বিশ্বাস এবং আচরণের ইতিবাচক পরিবর্তন যা এই শোষণমূলক অসম অবস্থা এবং সম্পর্ককে প্রতিহত করবে। নারীদের সম্পত্তি, জমির মালিকানা, উত্তরাধিকার, কর্মসংস্থান, একই কাজের জন্য পুরুষের সমান মজুরি নিশ্চিত করতে হবে। নারী-পুরুষ উভয়েরই আয় এবং অর্থনৈতিক উৎপাদন পরিচালনার ক্ষেত্রে সমান সুযোগ থাকতে হবে। অর্থনৈতিক ক্ষমতায়নের পাশাপাশি নারীদেরকে অধিকার সম্পর্কে সচেতন করা এবং তা দাবি করতে উদ্বুদ্ধ করতে হবে। পুরুষকেও এ ব্যাপারে সচেতন করতে হবে।
অর্থনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধযোগ্য। অন্যান্য সহিংসতার মতো অর্থনৈতিক সহিংসতা প্রতিরোধ করতে শুরুতেই ব্যবস্থা নিলে একদিকে অর্থ সাশ্রয় হয়, অন্যদিকে এর দীর্ঘমেয়াদি ইতিবাচক প্রভাব পড়ে। অর্থনৈতিক সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্তদের আইনি সেবা প্রদানের পাশাপাশি মনোসামাজিক সহায়তা প্রদান করা প্রয়োজন। এটি অবসানের জন্য দীর্ঘমেয়াদি প্রতিশ্রুতির পাশাপাশি সমাজের প্রতিটি খাতকে বিবেচনায় রেখে একাধিক কৌশলপত্র ব্যবহার প্রয়োজন। সর্বোপরি সহিংসতা মোকাবিলার জন্য রাজনৈতিক সদিচ্ছা এবং প্রতিশ্রুতি অতীব গুরুত্বপূর্ণ।