অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর অভিঘাত সহনশীলতা

October 24, 2021

ফিলিপাইন ও কেনিয়ার সরকার তাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ব্র্যাক গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে সেদেশের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করেছে। বর্তমানে প্রায় ৫০টি দেশে সরকার, এনজিওসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারা গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ সরকারও তার জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্রে ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামকে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি উপযুক্ত মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়াও গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের জীবিকায়ন প্রকল্পও বাস্তবায়িত হচ্ছে।

২০৩০ সালের মধ্যে নির্ধারিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের আর মাত্র নয় বছর বাকি। ১৭টি লক্ষ্যমাত্রার প্রথম এবং মূল লক্ষ্য ‘সর্বত্র সব ধরনের দারিদ্র্যের অবসান’ অর্জন, অর্থাৎ পৃথিবীকে দারিদ্র্যমুক্ত করার জন্য এখনো পাড়ি দিতে হবে দীর্ঘ বন্ধুর পথ।

কোভিড-১৯ মহামারির কঠিন আঘাত আমাদের যে নতুন বাস্তবতার মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে তা হলো, একটি দেশের অর্থনীতির চাকা যতই গতিময় হোক, পরিসংখ্যান সেখানকার দারিদ্র্যের হার যতই কমতির দিকে দেখাক, একটা বড়ো অভিঘাত বা বিপর্যয় সেই সাফল্যকে হুমকির মুখে ঠেলে দিতে পারে। ২০২০ সালের শুরুতে বিশ্বের দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ছিল প্রায় ৭০০ মিলিয়ন। বিশ্বব্যাংকের হিসাব অনুযায়ী কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে সৃষ্ট অর্থনৈতিক অভিঘাতের ফলে ২০২১ সালে এই সংখ্যার সঙ্গে যোগ হবে আরও ১০০ মিলিয়ন জনগোষ্ঠী।

বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী কোভিড-১৯ মহামারির আগে থেকেই বিশ্বব্যাপী দারিদ্র্য হ্রাসের হার কমে আসছিল। নগর দারিদ্র্য, জলবায়ু পরিবর্তন, যুদ্ধ ইত্যাদি কারণে বাস্তুচ্যুত হওয়া, দারিদ্র্যের নিত্যনতুন এবং জটিল ধরন এবং সেগুলোকে মোকাবিলা করতে না পারার কারণেই এটি ঘটেছে। অন্যদিকে সকল জনগোষ্ঠীর মধ্যে অর্থনৈতিক উন্নয়নের সুফল সমানভাবে বণ্টন না হওয়ায় বাড়ছে ধনী ও দারিদ্র্যের মধ্যে বৈষম্য। এই প্রেক্ষাপটে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রান্তিক ও অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠী।

অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর সমস্যা ও চাহিদাগুলো বহুমুখী। শিক্ষা, চিকিৎসা, স্বাস্থ্যসেবা ইত্যাদি অধিকারসহ সরকারি-বেসরকারি কার্যক্রম বা সেবায় তাদের অভিগম্যতা নেই। ফলে মূলধারার দারিদ্র্য বিমোচন কার্যক্রমগুলো তাদের অবস্থার দীর্ঘমেয়াদি পরিবর্তন ঘটাতে পারে না। বিভিন্ন দেশের সরকার এই জনগোষ্ঠীগুলোর জন্য যে সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচি পরিচালনা করে সেগুলো স্বল্পমেয়াদে কিছুটা স্বস্তি দেয় কেবল। এই পরিস্থিতির সঙ্গে কোভিড-১৯ অতিমারির অভিঘাত যুক্ত হওয়ায় সারা বিশ্ব জুড়েই অতিদরিদ্র এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী এর আঘাত সামাল দিতে পারেনি। তারা কাজ বা আয় হারিয়ে দুঃসহ জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।

অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই জীবনমান উন্নয়নের জন্য এমন কর্মসূচি দরকার যেগুলো তাদের মধ্যে অর্থনৈতিক বা প্রাকৃতিক অভিঘাতের প্রতি সহনশীলতা তৈরি করবে। এক্ষেত্রে ব্র্যাক উদ্ভাবিত গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ একটি কার্যকর দারিদ্র্য বিমোচন মডেল হিসেবে ইতিমধ্যেই বিশ্বব্যাপী স্বীকৃতি পেয়েছে। এই মডেলটির অন্যতম বৈশিষ্ট্য হলো এটি বিভিন্ন প্রেক্ষাপট এবং পরিস্থিতিতে কর্মসূচির মূল কাঠামোকে ঠিক রেখে কার্যক্রম নির্ধারণ করতে পারে যার ফলে কার্যকরভাবে অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীকে খুঁজে বের করা, তাদের বহুমুখী চাহিদাকে চিহ্নিত করা এবং সেই অনুযায়ী সহায়তা প্রদান করার মাধ্যমে তাদের জীবনমানের টেকসই উন্নয়ন ঘটানো সম্ভব হয়।

Photo credit: Pronob Ghosh © BRAC

ব্র্যাক ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশে আলোকে আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামের মাধ্যমে গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচের বাস্তবায়ন করছে। প্রথমে গ্রামীণ অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য কার্যক্রম পরিচালনা করা দিয়ে শুরু হলেও বর্তমানে সংস্থাটি শহরবাসী, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, জলবায়ু পরিবর্তন এবং রোহিঙ্গা শরণার্থীদের আগমনের ফলে অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্যও তাদের নিজ বাস্তবতা অনুযায়ী গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম পরিচালনা করছে। শুধু তাই নয়, কোভিড-১৯ অতিমারির কারণে দেশজুড়ে চলমান অর্থনৈতিক স্থবিরতার সময়ও ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে খাপ খাইয়ে কর্মসূচির কার্যক্রমে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন করেছে। ফলস্বরূপ ২০২০ সালে কর্মসূচির ৯৮% সদস্য কর্মসূচি থেকে সফলতার সঙ্গে উত্তরণ করেছে এবং কোভিড-১৯ অতিমারি সৃষ্ট অর্থনৈতিক অভিঘাত স্বত্ত্বেও তারা আর্থসামাজিক উন্নয়নের পথে যাত্রা করেছে।

সম্প্রতি লন্ডন স্কুল অব ইকনমিকস এবং ব্র্যাক ইনিস্টিটিউট অব গর্ভানেন্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট ব্র্যাকের গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর মধ্যে অভিঘাত বা বিপর্যয়কে মোকাবিলা করার এবং এর মাধ্যমে নিজেদের আর্থিক অবস্থাকে ধরে রাখার সক্ষমতা তৈরি করে কি না সে বিষয়ে  একটি গবেষণা পরিচালনা করেছে। সেটিতে  দেখা গেছে, ১০ বছর আগে কর্মসূচিটি থেকে গ্র্যাজুয়েট হয়ে যাওয়া সদস্যদের মধ্যে যারা ভালো চাকরি করছেন বা যাদের আয়মূলক সম্পদ আছে তারা কোভিড-১৯ অতিমারি শুরুর সময় এবং চলমান অবস্থায় দেশ জুড়ে বিদ্যমান অর্থনৈতিক অবরোধ স্বত্ত্বেও  তারা কাজকর্ম হারিয়ে আবার অতিদরিদ্র অবস্থায় পতিত হননি। এক্ষেত্রে বয়সে তরুণ সদস্যরা বেশি ভালো করেছেন। এই প্রাক্তন সদস্যরা অভিবাসন করতেও বাধ্য হননি যা কোভিড-১৯ অতিমারির সময় সারা দেশ জুড়েই বেড়ে গিয়েছিল।

ফিলিপাইন ও কেনিয়ার সরকার তাদের সামাজিক সুরক্ষা কর্মসূচিতে ব্র্যাক গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচকে সংযুক্ত করার মাধ্যমে সেদেশের অতিদরিদ্র জনগোষ্ঠীর টেকসই উন্নয়নে ভূমিকা রাখতে সহায়তা করেছে। বর্তমানে প্রায় ৫০টি দেশে সরকার, এনজিওসহ বিভিন্ন স্টেকহোল্ডারা গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রাম বাস্তবায়ন করছে। বাংলাদেশ সরকারও তার জাতীয় সামাজিক সুরক্ষা কৌশলপত্রে ব্র্যাকের আলট্রা-পুওর গ্র্যাজুয়েশন প্রোগ্রামকে দারিদ্র্য বিমোচনের একটি উপযুক্ত মডেল হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। এছাড়াও গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচ থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন ধরনের জীবিকায়ন প্রকল্পও বাস্তবায়িত হচ্ছে।

এ বছর ‘সকলে মিলে এগিয়ে চলি, করি দারিদ্র্য বিমোচন: মানুষ ও প্রকৃতিকে করে সম্মান প্রদর্শন’ ((Building Forward Together: Ending Persistent Poverty, Respecting all People and our Planet))-এই প্রতিপাদ্যকে ধারণ করে পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক দারিদ্র্য বিমোচন দিবস। এই আহবানের সঙ্গে সংহতি জানিয়ে গ্র্যাজুয়েশন অ্যাপ্রোচসহ অন্যান্য কার্যকর দরিদ্র্য বিমোচন কর্মসূচিগুলোকে যথাযথভাবে চিহ্নিত করে, সমন্বিতভাবে সেগুলোর সম্প্রসারণ এবং বাস্তবায়ন ঘটাতে হবে – এটাই হোক এবারের দারিদ্র্য বিমোচন দিবসে আমাদের অঙ্গীকার।

 

সম্পাদনা- তাজনীন সুলতানা

Cover photo: Pronob Ghosh © BRAC

1 1 vote
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Inline Feedbacks
View all comments